রাজনীতিঃ
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ হচ্ছে নির্বাচন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়। গ্রহণযোগ্য না হলে সেই ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই নির্বাচন শুধু আইনি বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়, এর সঙ্গে ক্ষমতার বৈধতা, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত—এ সবকিছুই জড়িত। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে সাতবার সামরিক শাসনসহ দলীয় সরকার ও চারবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, নির্বাচনের ফলাফল এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে পাঁচ পর্বের লেখার আজ দ্বিতীয় পর্ব।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনাবিদ্রোহে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার। ওই বছরের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। এতে এম এ জি ওসমানী ও ড. কামাল হোসেনের মতো প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তার বিজয়ী হন। ২৭ নভেম্বর তিনি ৪২ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল ও অনৈক্য তীব্র হয়ে ওঠে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানে সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন। দেশে সামরিক আইন জারি হয়। সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। এ সময় মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধান স্থগিত করা হয়। ২৭ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণে পদত্যাগ করলে এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৯৮৫ সালের ১ মার্চ এরশাদ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শীর্ষস্থানীয় অনেক বিরোধী নেতাকে আটক করা হয়। সামরিক আইনের কড়া বিধিনিষেধের মধ্যেই মার্চ মাসে জিয়ার মতো এরশাদও গণভোটের আয়োজন করেন। এতে তাঁর পক্ষে ৯৪ ভাগ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়। একই বছরের মে মাসে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদ আমলে চালু হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখে থাকেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট যে এটা ছিল এরশাদের দল গঠন এবং রাজনীতিতে প্রবেশের একটি কৌশল।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এরপর তিনি তৃতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করেন। বারবার পরিবর্তনের পর ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫–দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭–দলীয় জোট এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছিল। প্রথম দিকে কোনো দলই এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায়নি।
এ বিষয়ে বিএনপি: সময়–অসময় বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘১৫ ও ৭–দলীয় জোট ১৭ মার্চের যৌথ সভায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ১৯ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক জনসভায় ১৫–দলীয় জোটের নেতা শেখ হাসিনা “স্বৈরাচারের নির্বাচনে” অংশগ্রহণকারীদের “জাতীয় বেইমান” হিসেবে চিহ্নিত করার ঘোষণা দেন।
১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এরশাদ বলেন, বিরোধী দলগুলো এক রাতের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা না দিলে নির্বাচনবিরোধী সব তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। এ রকম অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও ১৫–দলীয় জোটের কয়েকটি দল নাটকীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৫–দলীয় জোট এবং জোটের শরিক দল জাসদ আবার ভেঙে যায়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭–দলীয় জোট এবং বামপন্থিদের ৫–দলীয় জোট শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করে। অন্যদিকে নবগঠিত জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, জাসদ (রব), জাসদ (সিরাজ), জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, সিপিবিসহ ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৫২৭ জন।
প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ১৫৩টি আসনে জয়ী দেখানো হয়। ৭৬টি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ সংসদের বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ১০টি, সিপিবি ও এনএপি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) উভয়েই ৫টি করে এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও জাসদ (রব) ৪টি করে আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছিলেন ৩২টি আসনে।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ভোট প্রদানের হার ছিল ৬০ দশমিক ৩১ শতাংশ। মোট বৈধ ভোটের ৪২.৩৪ ভাগ জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ ২৬.১৬ ভাগ পেয়েছিল। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ৪.৬১ ভাগ, জাসদ (রব) ২.৫৪ ভাগ এবং মুসলিম লীগ ১.৪৫ ভাগ, এনএপি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) ১.২৯ ভাগ, এবং সিপিবি ০.৯১ ভাগ ভোট পেয়েছিল।
আগের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় তৃতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল ছিল আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষণ সংস্থার মতে, ভোটার উপস্থিতি ছিল বড়জোর ২০ শতাংশ। নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি, অনিয়ম ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা সরকারি দলকে এসব কাজে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ তাদের হেরে যাওয়া ১০০ আসনে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলে। অন্যদিকে বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জন করা বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনকে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ‘আঁতাত’ বলে অভিহিত করেছিল। এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি: সময়-অসময় বইয়ে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘সামরিক শাসনের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে আওয়ামী লীগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অন্যদিকে নির্বাচনের টোপ না গেলার কারণে অথবা যেভাবেই হোক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য খালেদা জিয়ার ‘‘আপসহীন’’ ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।’
১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট এরশাদ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন এবং সেপ্টেম্বরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হন। ১৫ অক্টোবর আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১১ নভেম্বর সংসদে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বিল পাস হয়। এর মাধ্যমে এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়া হয়।১৯৮৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ এরশাদের ক্ষমতা দখলকে আইনি বৈধতা দিলেও তাঁর রাজনৈতিক বৈধতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা, বেশির ভাগ বিরোধী দল তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারকে বৈধ সরকার হিসেবে মেনে নেয়নি। তারা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল।
১৯৮৭ সালের শেষ দিকে আন্দোলন তীব্র হয়। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগসহ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় বেশির ভাগ সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। এমন পরিস্থিতিতে এরশাদ ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ৭ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেন।
দেশে নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার পরও ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ আবার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরিস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছিল, বিরোধী দলগুলোর চলমান আন্দোলনকে দুর্বল করতেই এরশাদ ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন। বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচন বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়। ২ ও ৩ মার্চ হরতাল আহ্বান করা হয়। অপরদিকে সরকার সব ধরনের নির্বাচনবিরোধী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং বিরোধী দলগুলোর বহু নেতা–কর্মীকে কারারুদ্ধ করে।
এ রকম ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করায় ওই নির্বাচন নিয়ে মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। জাতীয় পার্টি ও এরশাদের ‘অনুগত’ ছোটখাটো কিছু দল সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। এতে মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ১২০ জন।
প্রশ্নবিদ্ধ ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি অর্থাৎ ২৫১টি আসনে জয়ী দেখানো হয়। অন্যদিকে জাসদের (রব) নেতৃত্বে কপ (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ) পায় ১৯টি আসন। এ ছাড়া জাসদ (সিরাজ) ৩টি ও ফ্রিডম পার্টি ২টি আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ২৫টি আসন।
সরকারি হিসাবে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৪.৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ৬৮.৪৪ ভাগ ভোট। কপ ১২.৬৩ ভাগ, জাসদ (সিরাজ) ১.২০ ভাগ এবং ফ্রিডম পার্টি ৩.২৯ ভাগ ভোট পায়।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচন ছিল একটি ‘একতরফা’ নির্বাচন। এতে অনেক দলের অংশগ্রহণ দেখানো হলেও প্রধান বিরোধী দলগুলোই ছিল নির্বাচনের বাইরে। তারা নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ডাক দিয়েছিল। বিরোধীদের মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকেও নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ বইয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান লিখেছেন, ‘…তাদের (বিরোধীদের) তৎপরতার বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তার জন্য সরকার উপজেলা পর্যায়ে সেনা মোতায়েন করেছিল। তাই কারও অংশগ্রহণে ‘‘বাধা’’ না থাকা সত্ত্বেও এ নির্বাচনটি উন্মুক্ত ছিল না।’
প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি ক্ষমতা ধরে রাখে। ফ্রিডম পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে আ স ম আবদুর রব সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ফলে অনেকেই তাঁকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালের মতো ১৯৮৮ সালের নির্বাচনও এরশাদকে রাজনৈতিক বৈধতা দিতে পারেনি। এরশাদ আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো নিয়ে বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেম অ্যান্ড ইস্যুজ বইয়ে রওনক জাহান লিখেছেন, ‘এরশাদ আমলে ১৯৮৪ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, ১৯৮৫ সালের গণভোট, ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৮৮ সালে আরেকটি সংসদ নির্বাচনসহ অনেকগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এ নির্বাচনগুলো সরকারের জন্য বৈধতার চেতনা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়।’
১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচনে বড় জয়ের পরেও এরশাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যায়। এর পরিণতিতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর পতন হয়।