কঠোর বিধিনিষেধে রুটিরুজি নিয়ে চিন্তিত নিম্ন আয়ের মানুষ

প্রকাশিত: ২:০৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ২, ২০২১

হাতে কোদাল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দিনমজুর রমজান আলী। কাউকে সামনে দেখলেই চাতক পাখির মতো ছুটছেন তার কাছে। শুধু রমজান নন, তার মতো আরও ২০-২৫ জন দিনমজুর কাজের আশায় অপেক্ষা করছিলেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় বৃহস্পতিবার কাকডাকা ভোরে এমন চিত্র দেখা যায়।

লকডাউনে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষই কিছু না কিছু দুর্ভোগে পড়েন। তবে সবার সমস্যা এক রকম নয়। খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষগুলোর কাছে ‘লকডাউন’ মানেই তিন বেলা খাবারের অনিশ্চয়তা। লকডাউনের কথা শুনেই তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন। ঘর থেকে বের হতে না পারলে কেমনে হবে, কাজ না করলে খাবেন কী, কিভাবে সংসার চালাবেন- এ চিন্তায় তাদের ঘুম হারাম। তাদের মতে, লকডাউন মানেই মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের ‘মাথায় হাত’। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারা দেশে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে শুরু হয়েছে ৭ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ (লকডাউন)।

যা ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে। জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস, গণপরিবহণসহ যন্ত্রচালিত সব ধরনের যানবাহন, শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হলেই গ্রেফতার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আসন্ন কোরবানির ঈদের আগে এমন বিধিনিষেধে রুটি-রুজি নিয়ে চরম চিন্তিত নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষগুলো। দিনমজুর রমজান আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘কামের (কাজ) আশায় দাঁড়িয়ে আছি। একটা কাম দ্যান স্যার। কাম না করলে খামু কি? পরিবার চালামু ক্যামনে? কাম না থাকলে পেটে ভাতও নাই। লকডাউনে আমাগো মতো গরিব মানুষের মাথায় হাত পড়ছে।’ যাত্রাবাড়ীতে একটি ছোট্ট কারখানায় কাজ করেন দুই ডজন শ্রমিক। সেখানকার শ্রমিক আমিনুল রহমান বুধবার বলেন, ‘লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকব। রাতেই একটি পিকআপ ভ্যানে করে ১৫ জন শ্রমিক গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা দেব।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিছু করার নেই। কোনো উপায়ও নেই। ঈদের আগে রোজগার করতে না পারলে পরিবারের কাউকে কিছু দিতে পারব না। এর চেয়ে আর দুর্ভাগ্য কি হতে পারে।

মধ্যবয়সি রিকশাচালক হুমায়ুন মিয়া যুগান্তরকে বলেন, দিন আনি, দিন খাই। যেদিন কামাই নাই, সেদিন খাওয়াও নাই- ঠিক এমনই অবস্থা। করোনার সময় রিকশা চালাতে পারছি বলেই কিছু আয়-উপার্জন হচ্ছে। নয়তো না খেয়ে মরতে হতো। রাস্তায় লোকজন কম। তাই ভাড়াও কম। সরকারি সাহায্য পেলে ভালো হতো। কোনো মতে খেয়েপরে দিন কাটাতে পারতাম।

বেসরকারি একটি কোম্পানিতে কাজ করেন খালিলুর রহমান। তার কষ্টটাও অনেকটা একই। ৭ দিন কাজ না-করলে বেতন কাটা যাবে। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারও অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হবে বলে জানান তিনি। খালিল বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তো আর কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো আমাদের মতো বেসরকারি কর্মচারীদের। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

টং চায়ের দোকানি ইমন হোসেনের দুশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। দোকান না-চললে রাজধানীতে পরিবার নিয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা খুবই কঠিন। তাই তিনি ত্রাণের আশায় আছেন। ইমন বলেন, ত্রাণ কপালে জুটলে খাওয়া জুটবে। নয়তো কোনোমতো অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হবে। কথা হয় ভ্রাম্যমাণ বিভিন্ন পণ্যের দোকানিদের সঙ্গে। তারাও হতাশা আর শঙ্কার কথা জানান। ঝালমুড়ি বিক্রেতা ফজল মিয়া বলেন, আগে স্কুল-কলেজের সামনে ঝালমুড়ি বানিয়ে বিক্রি করতাম। এখন সেগুলো বন্ধ হওয়ায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করি। এ কাজের ওপর নির্ভর করে বাসায় থাকা বৃদ্ধ মা-বাবাসহ চারজনের জীবন। মানুষজন ঘর থেকে বের না-হলে বিক্রি করব কার কাছে। বড়ই কষ্টে আছি।

কিশোর ভ্রাম্যমাণ পান-বিড়ি বিক্রেতা মামুন মিয়ারও কষ্ট একই রকম। রাস্তায় বের না হলে খাবে কী, তাই নিয়ে সে চিন্তিত। মামুন বলেন, ঘরে মা ও তিন ভাই-বোন রয়েছে। মা অন্যের বাসাবাড়িতে গৃহস্থালি কাজ করেন। মামুন ও তার মায়ের উপার্জন দিয়েই চলে তাদের পরিবার। লকডাউনে তার আয় অর্ধেকে নেমেছে। রাস্তায় লোকজন কম বলে বিক্রি কম হচ্ছে। এ দুঃসময়ে অন্যের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে জানান তিনি।

যাত্রাবাড়ী বাজার এলাকায় থাকা দিনমজুর আরমান মিয়া বলেন, বাজারে লোকজন এলে তাদের বাজার-সদাই বাসায় পৌঁছে দেই। তাতে ২০-৫০ টাকা করে দেয়। সারা দিন এভাবে কাজ করে যা পাই, তা দিয়েই চারজনের সংসার চালাই। কোনো ব্যবসা করব যে সে টাকাও নেই। বাধ্য হয়ে দিনমজুরের কাজ করি। কিন্তু লকডাউনে কাজের সুযোগ অনেক কমে গেছে। আমাগো মতো গরিবের দিকে তাকানোর লোক কই?