ডেস্ক রিপোর্ট :
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু থেকে সহিংস আকার ধারণ এবং সর্বশেষ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অন্তত চার রকমের বড় ধরনের ‘ভুল বুঝাবুঝি’ সামনে এসেছে। এবং এর ফলে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, তাদের যৌক্তিক আন্দোলন ও দাবি কেউ বুঝলো না।
আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা তৈরি না হওয়ায়, সুবিধাবাদীদের ইনটেনশন বুঝতে অসমর্থ হওয়ায়— এধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আদালতে শুনানি করার সময়টুকু আন্দোলনকারীরা দিতে পারতেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তারা অরাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবেই বিবেচনা করলেও বর্তমানে এ আন্দোলন যে রূপ নিয়েছে, তাকে অরাজনৈতিক আন্দোলন বলা যাবে না।
উল্লেখ্য, কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্রকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করায় এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর ধারাবাহিকতায় গত এক সপ্তাহে প্রতিটি কর্মদিবসে কোনও দিন ‘ব্লকেড’ ও কোনও দিন সড়কের পাশাপাশি রেলপথও অবরোধ করেন তারা। এরইমধ্যে প্রকাশ হয়েছে হাইকোর্টের রায়ের বাস্তবায়নযোগ্য আদেশ, যেখানে কোটা বহাল রেখে প্রয়োজনে তা সংস্কার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে আপিলে হাইকোর্টের রায়টি চার সপ্তাহের জন্য ‘স্থিতাবস্থা’ দেওয়া হয়।
কোটাবিরোধী না কোটা সংস্কার
শুরু থেকে আন্দোলনকারীরা কোটার বিরোধী নাকি কোটা সংস্কার চায়, সে নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান তৈরি হয়। তথপ্রতিমন্ত্রী মোহম্মদ এ আরাফাত গত ১৩ জুলাই বলেছেন, ‘আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় দাবি পরিবর্তন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আছে— নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা। এগুলো কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে ধারণা না থাকলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।’ আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা বরাবরই সংস্কারের পক্ষে। ২০১৮ সালে যেহেতু কোটা বাতিল করা হয় এবং সম্প্রতি হাইকোর্ট সে পরিপত্র বাতিল করলে কোটা যেহেতু বহাল হয়, সেহেতু আমাদের দাবি কোটাবিরোধী হিসেবে পরিচয় পায়। আমরা সবসময়ই আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি।’
আদালতে সমাধান সম্ভব, সেটা আন্দোলনকারীরা মানলো না
হাইকোর্টের আংশিক প্রকাশিত রায়ে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে পরিপত্র সরকার জারি করেছিল, তা ‘অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’। এদিকে, এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেটা মেনে না নিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান।
আসলে আদালতের বাইরে সমাধান সম্ভব কিনা প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এখন তো বিষয়টি বিচারাধীন, এখন কিছু করার নাই। আমরা হাইকোর্টের রায়ের পর পরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আপিল শুনানির জন্য আদালত সময় নিয়েছে। শুনানির পর আদালত কী সিদ্ধান্ত দেয় সেটা দেখতে হবে।’
পিএম যা বলেননি সেটা সামনে আনা হলো
এরপর প্রধানমন্ত্রীর একটা বক্তব্য ধরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলো, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। চীন সফর উপলক্ষে গত ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আজকে যে কোটা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, সেই কোটার সুবিধা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতিরা না পেলে কারা পাবে?’ এর মানে হচ্ছে, তিনি একটা প্রশ্ন তুলেছেন—মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি তো কোটা পাবে না। তাহলে কি রাজাকারদের সন্তান বা নাতিরা পাবে? যারা আন্দোলন করছে, তিনি তাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন। কিন্তু তিনি কখনোই বলেননি, যারা আন্দোলন করছে বা যারা দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, তারা বা তাদের ভাইবোনেরা রাজাকার। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রাতেই ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলে রাস্তায় নামেন আন্দোলনকারীরা। তাদের কে রাজাকার বলেছে সে প্রশ্ন নিজেদের করেননি। ঠিক পরের দিনে ছাত্রদল সংবাদ সম্মেলন করে শুরু থেকে আন্দোলনে শামিল থাকার কথা স্বীকার করলে ঘুরে যায় গতিপথ।
শুরু থেকে ভেতরে ছিল ছাত্রদল-শিবির
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থেকে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে ছাত্রদল। এদিকে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের পুরো নেটওয়ার্কটি ছাত্রশিবিরের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রলীগ শুরু থেকে দাবি করে আসছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কলকাঠি নাড়ছে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী গত শনিবার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে গণমাধ্যমে বলেন, ‘কোনও আন্দোলনে যৌক্তিকতা থাকলে, তা দুর্ভোগ সৃষ্টি করলেও জনগণ মেনে নেয়। কিন্তু আজ যখন স্পষ্ট হয়ে গেলো— আন্দোলনকারীদের দাবির পক্ষেই সরকার আইনি লড়াই করছে, সরকারই আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে পক্ষভুক্ত হয়েছে, তখন আন্দোলনের নামে রাস্তা বন্ধ করে জনর্ভোগ তৈরি করা একেবারেই অযৌক্তিক। কোনও আন্দোলন কখনও সফল হয় না, যদি এর যৌক্তিক ভিত্তি না থাকে। সরকারের দায়িত্ব জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হলে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া।’
কার কখন কোথায় প্রাণ যায়
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুর থেকেই নানা জায়গায় সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা-নাগাদ চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে হামলায় জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তখন আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভেতর ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির প্রবেশ করে। কেউ দাবি করছেন— নিহতরা পুলিশের গুলিতে ও ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয়েছে। কেউ দাবি করেছেন, তারা আন্দোলনকারীদের হামলায় নিহত হয়েছেন। কেউ বলছেন, দুই পক্ষের হামলার মাঝে পড়ে তারা নিহত হয়েছেন। যে ভিডিওতে ছাত্রলীগকে ভবন থেকে ফেলে দেওয়ার ক্যাপশন, সেটাই আবার অন্যখানে আন্দোলনকারীদের ফেলে দেওয়ার বলে প্রচার হতে শুরু করে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সরকার ও আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ কেউ কারও প্রতিপক্ষ হওয়ার কথা নয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে এত রকমের পক্ষের উপস্থিতি দেখতে পাই, যে মূল লক্ষ্য থেকে সরে যেতে দেখি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে অঙ্গীকারবদ্ধ। যারা ক্ষুব্ধ হয়ে বিভ্রান্ত পথে হাঁটেন, তারা ছাত্রসমাজের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করে না। আমরা তখনই বুঝতে পারি, মুক্তযুদ্ধবিরোধী সুযোগ সন্ধানীরা স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় আন্দোলনে ভর করেছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, ‘ভুল বুঝিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টাতো এখন স্পষ্ট। এই শিক্ষার্থীরা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে মনে করছেন। তাদের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু সেটা আদায়ের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে মাঠে নামার পরে আর পুরো বিষয়টি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। এই সময়টায় তাদের আচরণ অযৌক্তিক আকার ধারণ করে এবং একটার পর একটা ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হতে থাকে। তখন কোনও পক্ষই পারস্পরিক কথা বুঝাতে সক্ষম হয়নি।
সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট