করোনাকালের মে দিবস

অস্তিত্ব সংকটে দিনচুক্তির শ্রমিক

প্রকাশিত: ৩:২৩ অপরাহ্ণ, মে ১, ২০২০

সায়েদাবাদে মালামাল টানার শ্রমিক জাকির মিয়া এক ঝুড়ি ফল নিয়ে ফুটপাতে বসেছেন। পাশে ১০ বছরের সন্তান। ছেলেকে মাস্ক পরিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। তার কাজ পুলিশ আসছে কিনা দেখা। পুলিশের গাড়ি দেখলেই ঝুড়িটি নিয়ে পাশের গেটে ঢুকে পড়বেন। গত ১৫ দিন ধরে এটা তার কাজের অংশ। করোনার জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশ জারির পরে প্রথম কয়দিন তিনি বের হননি বাড়ি থেকে। পুলিশেরও কড়া পাহারা ছিল সেই সময়ে। এরপর ১৫ দিন যাওয়ার পরে টাকা ধার করে নেমে গেছেন ফুটপাতে, ভিন্ন পদ্ধতিতে নেমেছেন পাড়ার মধ্যে ঝুড়িতে ফলের ব্যবসা নিয়ে। জাকির মিয়া বলেন, ‘কিছু ত্রাণ পাইনি তা কই না। কিন্তু সারাদিন কি ডাইল দিয়া ভাত খামু নাকি? পোলা মাইয়ার মুখে কিসু দিতাম না?’


ইমারত নির্মাণ শ্রমিক কবির। শেষ কাজ করেছেন ২৭ মার্চ। যে বাসার কাজ করছিলেন তারা কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় মাথায় হাত পড়ে তার। এক সপ্তাহের মজুরির টাকা হাতে ছিল, কিন্তু তারপর? কবির বলেন, বউ গর্ভবতী। দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখার অপেক্ষায় সামনে আরও এক মাস। শেষের এই দুই মাস বাচ্চার স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। সেসব ডাক্তার আপা বলে দিয়েছিলেন, কিন্তু এই এক মাসে আসলে তেমন কিছুই বাড়তি সে খেতে পায়নি।

মাল টানা শ্রমিক, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক কিংবা যেকোনও দিনমজুরের জন্য আবারও এসেছে মে দিবস, মজুরি ও শ্রমঘণ্টার অধিকারের কথা বলার দিন। কিন্তু এবার পকেটে টাকা নেই, হাতে কাজ নেই, কবে আসবে তাও জানেন না তারা। এমনকি তাদের যে সংগঠনগুলো আছে তারা বলতে পারছেন না, কবে লকডাউন শেষ হবে। কবে দিনচুক্তির শ্রমিকরা আবার কাজে ফিরে দুশ্চিন্তা মুক্ত হবেন। কিন্তু আদৌ দুশ্চিন্তামু্ক্ত হবেন তো? কেননা, আছে কাজ না থাকার ভয়। নির্মাণ শ্রমিক কবির বলেন, কাজ আসলে কে করাবে? তার হাতেও তো টাকা থাকা লাগবে। মানুষ এই দেড় মাসে বুঝে গেছে সে কত অসহায়।


১ তারিখ মে দিবস তথা শ্রমিক দিবস জানেন কিনা প্রশ্নে কবির বলেন, পেটে ভাত নাই, শ্রমিক দিবস। আগেও কোনোদিন পালন করা হয়নি। এদিন কাজ বন্ধ থাকে সবসময় এমনও না। আমাদের অনেক সংগঠন আছে, কিন্তু কোনটার সঙ্গে যুক্ত হবো বুঝতে না পেরে কোনোটাতেই নেই।

ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. ওসমান গণি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দক্ষতা অনুযায়ী দিনে চারশ’ থেকে সাতশ’ টাকায় কাজ করেন ইমারত শ্রমিকেরা। গত একমাস ঘরে বসা। সবকিছু এখন খুলে দিলেও সবাই কাজ পাবেন বলে মনে হয় না। তিনি আরও বলেন, এই সময়ে আমরা কোনও সরকারি আশ্বাস পাইনি। নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য আসলে কী করণীয়, তা কি সরকার ঠিকমতো নির্ধারণ করতে পেরেছে? মে দিবসের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসমান গণি বলেন, আর কয়েকটা সেক্টর বাদে মে দিবসের বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি তৎপরতা লক্ষ করা যায় না।


দিন চুক্তির মজুর, নির্মাণ শ্রমিকদের কাছে এই করোনাকালটি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা তাদের কাছে মুখ্য না। জীবন ও জীবিকা বড় বিষয়। সরকারি ওয়াদা অধিকাংশের কাছে পৌঁছেনি। ফলে মে দিবস এবার যে পরিপ্রেক্ষিতে, এরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, অবহেলিত। এদের এ অবস্থার মধ্যে রেখে বাকি সমাজ নিরাপদে থাকবেন বলে মনোভাব কাজ করছে সমাজে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেভাবে লাখ লাখ কর্মীকে ডেকে এনে কারখানায় ঢোকানো হলো তাতে তাদের আসলে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। স্বাস্থ্যগত বিবেচনা মুখ্য নয়। উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় আছে বলে লকডাউনে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছেন, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণি সেটি পারছে না। মে দিবস শ্রমিকদের অধিকারের, সংহতির, ঐক্যবদ্ধতার এবং নতুন করে প্রেরণার দিবস। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেটি ছাপিয়ে মহামারির মধ্যে তারা টিকে থাকবেন কিনা এটিই এখন তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।