চীনসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনা ভাইরাস (২০১৯-এনসিওভি)। এতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২৪ থেকে ২৫ হাজার মানুষ, মারা গেছেন ৫০০ জনের মতো। নতুন এ ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশেও। আতঙ্কের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেড়েছে মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাস্কের দাম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আতঙ্কে মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। দেশে করোনা আক্রান্তের কোনও তথ্য না থাকায় এখনই মাস্কের ব্যবহার জরুরি নয় বলে জানিয়েছেন তারা। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদেরই কেবল সঠিক মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া করোনা মহামারি আকার ধারণ করলে সেক্ষেত্রে সবারই সঠিক মাস্কের ব্যবহার প্রয়োজন হবে।
বিক্রেতারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের খবর জানার পর প্রথমদিকে অনেকে ৫০০ থেকে এক হাজার এমনকি দুই হাজার মাস্ক পর্যন্ত কিনে নিয়েছেন। আর বিক্রেতারা যেসব কোম্পানি থেকে এগুলো কিনতেন, সেসব কোম্পানি থেকে এখন আর সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে না।
তারা বলছেন, ‘কোম্পানির লোক আসে না।’ তাদের দাবি, ‘এর আগে যেসব সার্জিক্যাল মাস্ক তারা বিক্রি করতেন, সেগুলো বেশিরভাগই ছিল চীন আর ভারতে তৈরি। কিন্তু সেগুলো এখন আর আসছে না।’
এ বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, একটি কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা চলছে। ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় এই অসৎ পন্থা বেছে নিয়েছেন। তবে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানায় অধিদফতর।
শাহবাগের ওষুধ মার্কেটের নিউ পপুলার ফার্মেসিতে মাস্ক কিনতে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফজলুল করিম আশিক। কিন্তু সেখানে মাস্ক না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৮-১০টি ফার্মেসি ঘুরেছি, কোথাও মাস্ক পাইনি।’ ফজলুল করিম বলেন, ‘এখন বোধহয় এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ওষুধটিও পাওয়া যাবে, কিন্তু পাঁচ টাকার মাস্ক পাওয়া যাবে না।’
দাম বাড়ার বিষয়ে শাহবাগের ওষুধ মার্কেটের বেল-ভিউ ফার্মার মালিক রিপন সামাদ বাংলা বলেন, ‘দেশে ফেস মাস্কের চাহিদা বছর জুড়ে থাকে ১০ হাজারের মতো। কিন্তু হঠাৎ করে সেই চাহিদা দুই থেকে তিন লাখে ঠেকেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। গত সপ্তাহের শুরুতে অনেকে এসে যত দামই হোক না কেন, মাস্ক চেয়েছেন, অথচ আমরা দিতে পারিনি। আমরা তো প্রোডাক্টই পাচ্ছি না, দেবো কোথা থেকে?’
দেশে প্রয়োজনীয় মাস্কের সংকট আছে কিনা জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, শিগগিরই জাপান সরকার বাংলাদেশকে ৭০ লাখ মাস্ক বিনামূল্যে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই মাস্কগুলো দেশে এলে বাজারে কোনও সংকট থাকবে না।
এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সব মানুষকেই মাস্ক পরে বাইরে ঘোরার প্রয়োজন নেই। যাদের সর্দি, কাশি, জ্বর আছে শুধু তারাই মাস্ক ব্যবহার করবেন, যাতে তাদের কাছ থেকে কোনও ছোঁয়াচে রোগ অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত না হয়।’
বিশেষজ্ঞরাও এমন কথাই বলছেন। করোনা ভাইরাস দেশে না থাকায় মাস্ক ব্যবহারের কোনও প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না তারা। তবে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করতে চাইলে বিষয়টি ভিন্ন বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বাংলা বলেন, প্রথমত বাংলাদেশে নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোনও রোগী পাওয়া যায়নি। তাই সাধারণ মানুষকে করোনার হাত থেকে বাঁচতে কোনও মাস্ক পরার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যদি কোনও ব্যক্তি আক্রান্ত হন, তখন তিনি মাস্ক পরলে আর কারও মাস্ক পরার প্রয়োজন হয় না। আসল কথা হলো রোগী মাস্ক পরলে ভাইরাস ছড়াবে না। আর তৃতীয়ত, বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে অনেকেই মাস্ক পরে, এটি ঠিক আছে।
ডা. আলমগীর বলেন, যদি চায়নার মতো করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়, তখনই কেবল বাইরে যেতে মাস্ক পরতে হবে। তার আগে মাস্ক পরার দরকারই নেই।
মাস্ক পরার এখন কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশে একজন রোগীও নেই, তাই সাধারণ মানুষের মাস্ক পরার দরকার নেই। বরং প্রশ্ন করা যায়, কেন পরবে? করোনার জন্য এখন মাস্ক পরা এক কথায় অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘রোগীর চিকিৎসক, নার্স, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং ভাইরাস নিয়ে যারা ল্যাবে কাজ করবেন তাদেরই কেবল মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ভাইরাস থেকে বাঁচতে তাদের এন-৯৫ মাস্ক পরতে হবে। তবে এর জন্য ট্রেনিং প্রয়োজন বলে জানান তিনি।’
একই কথা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, জ্বর, সর্দি বা কাশি হলেই করোনা ভাইরাস নয়। আর করোনা আতঙ্কে সবার মাস্ক পরারও প্রয়োজন নেই। দেশের সবাই যদি মাস্ক পরে ঘুরে বেড়ায় তাহলে মানুষের ভেতরে আতঙ্ক তৈরি হবে। কোন সময় মাস্ক পরতে হবে সে বিষয়ে চিকিৎসকরাই জানাবেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘করোনা ভাইরাস আতঙ্কে গত কয়েকদিনে ফেস মাস্ক ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে এসে না পৌঁছালেও ব্যবসায়ীরা ঠিকই ফেস মাস্কের দাম দুই থেকে তিনগুণ বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। অথচ সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করলে মাস্ক আমাদের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ কাপড়ের তৈরি মাস্ক ব্যবহার করছেন। অথচ এ ধরনের মাস্ক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং বাতাসে মিশে থাকা ক্ষতিকর গ্যাসীয়, তরল ও কঠিন পদার্থ থেকে কোনও সুরক্ষা দেয় না। এমনকি এগুলো ব্যবহারকারীর শরীর থেকে নির্গত হওয়া কফ, লালা, ঘাম ও থুথুর স্পর্শ থেকে অন্যদের মুক্ত রাখতে পারে না। উল্টো দীর্ঘক্ষণ কিংবা একই মাস্ক বারবার ব্যবহারের ফলে আমরা নিজেদের শরীরে জীবাণু চাষাবাদের পরিবেশ তৈরি করতে পারি। শ্বাসকষ্টের কোনও রোগী এ ধরনের মাস্ক ব্যবহার করলে তার সমস্যা বেড়ে যেতে পারে, এমনকি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াও বন্ধ হতে পারে।’
ডা. জাহিদ বলেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন হাত ধোয়ার ওপর। কারণ, খাবার গ্রহণ থেকে শুরু করে যেকোনও কাজ করতে হাত জীবাণুমুক্ত থাকা প্রয়োজন। অথচ বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।