সেলিনা আক্তার:
শুক্রবার ছুটির সকাল। ক্রেতা গমগম করছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে। বেসরকারি চাকরিজীবী আসমা আক্তার দরকারি পণ্যের ফর্দের সঙ্গে মুদি দোকানিকে এগিয়ে দিলেন কাপড়ের ব্যাগ; পলিথিনের শপিং ব্যাগ না দিতেও করলেন অনুরোধ। এ ঘটনায় তাঁর প্রশংসা করে দোকানি মাহমুদুর রহমান বললেন, ‘আপাই তো ঠিক কাজ করছেন। আপনার মতো সচেতন সবার হওয়া উচিত। পলিথিন চাইলেও দিতে পারব না, দোকানে রাখলেই জরিমানা।’ তবে একই ক্রেতা যখন কৃষি মার্কেটে মাছের বাজারে গেলেন, তখন পড়লেন বিড়ম্বনায়।
ক্রেতা আসমা বলেন, বাসা থেকে তো বাজারের ব্যাগ এনেছি। আলু-পেঁয়াজ এই ব্যাগেই নিয়েছি। তবে মাছের বাজারে ঠিকই পলিথিন সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পলিথিনের একটা বিকল্প দরকার আসলে।
ক্রেতাদের হাতে বাসা থেকে আনা পলিপ্রোপিলিন ব্যাগ যেমন দেখা যায়, তেমনই কৃষি মার্কেটে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগ বলে পরিচিত থলে বেচতে দেখা যায়। অথচ কাঁচাবাজারে শুক্রবার থেকেই পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন বা পলিপ্রোপিলিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন নিষিদ্ধের পরিস্থিতি দেখতে এদিন কৃষি মার্কেটে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর গঠিত মনিটরিং কমিটি। তখন ক্রেতা-বিক্রেতারা পলিথিনের বিকল্প বাড়ানোর দাবি জানান। মনিটরিং কমিটি বলেছে, প্লাস্টিক ব্যাগ যেহেতু বারবার ব্যবহার করা যায়, তাই আপাতত মানুষ এটা ব্যবহার করতে থাকুক। তবে পলিথিন একেবারে বাদ দিতেই হবে।
রোববার থেকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা: নিষিদ্ধ পলিথিনের শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটসহ আশপাশের বিভিন্ন সুপারশপে গতকাল মনিটরিং কার্যক্রম চালানো হয়। এ সময় মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, পলিথিনের শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে রোববার থেকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কার্যক্রম পরিচালনাকালে মনিটরিং কমিটির সদস্যরা কেনাকাটা করতে আসা লোকজনকে পলিথিন ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানান। এর পরিবর্তে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে বলেন। একই সঙ্গে দোকানিদের পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা দেন মনিটরিং কমিটির সদস্যরা। দোকানিদের বলা হয়, অভিযানে পলিথিন ব্যাগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ) তপন কুমার বিশ্বাস উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বাজারগুলোতে আপাতত জরিমানা করা হবে না। সতর্কতামূলক অভিযান নভেম্বরের প্রথম এক সপ্তাহ চলবে। এর পরের সপ্তাহ থেকে অভিযানে পলিথিনের ব্যাগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সব জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সুপারশপে ব্যবহার হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ: মনিটরিং কমিটি কৃষি মার্কেট পরিদর্শন শেষে মোহাম্মদপুরে প্রিন্স বাজার ও আগোরা সুপারশপে যায়। এই চেইনশপ দুটিতে পলিথিনের ব্যবহার নেই, বিকল্প হিসেবে কাপড়ের ব্যাগ বেচা হচ্ছে। মাছ বা মাংসের ক্ষেত্রে মোমের প্রলেপ দেওয়া কাগজের ব্যাগ, ব্রাউন ব্যাগ, কাপড় এবং পাটের ব্যাগ রাখতে দেখা যায়।
প্রিন্স বাজার সুপারশপের ব্যবস্থাপক শামসুদ্দিন ওমর বলেন, পরিবেশ যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আমরা সেভাবে কাজ করছি। আলাদা আলাদা আইডিয়া এনেছি। কেউ তিন হাজার টাকার কেনাকাটা করলে আমাদের পক্ষ থেকে দুটি করে ব্যাগ দেই। কেউ যদি পুরাতন ব্যাগ নিয়ে আসে, সেগুলো আমরা কিনে নেব। এরপর সেগুলো পরিষ্কার করে আবার বিক্রি করব। মানে পুনরায় ব্যবহার হচ্ছে।
২০০২ সালে আইন করে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি, পলিথিন ব্যাগে ছেয়ে আছে দেশের সব জায়গা। অন্তর্র্বতী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন। আর পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, মজুত, পরিবহন, বিপণন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে গতকাল থেকে শুরু হয় মনিটরিং। পলিথিন নিষিদ্ধের বিষয়ে শহুরে ক্রেতাদের একটি অংশ সচেতন থাকলেও বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, পলিথিনের বিকল্প সত্যিকারের পরিবেশবান্ধব ব্যাগের সরবরাহ এখনও অপ্রতুল।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছে। সরকারও বিকল্প সরবরাহের জন্য কাজ করছে। মানুষকে শাস্তি দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ক্ষতিকর এই ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য।
তিনি বলেন, পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ বন্ধের পর যেন বিকল্প ব্যাগের চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া যায়, সেজন্য বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ সরবরাহ করবে। এমনকি জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) তরফ থেকে প্রায় এক মাস আগে জানানো হয়েছিল, বিভিন্ন সুপারশপ ও নানা কোম্পানি থেকে এক কোটি ব্যাগের অর্ডার তারা পেয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান বাড়বে। তবে এক দিনে তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসবে।
কারওয়ান বাজার পাইকারি কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজন চৌধুরী বলেন, সবারই দেশের আইন মেনে ও পরিবেশ রক্ষা করে ব্যবসা করতে হবে। এর জন্য ব্যবসায়ীদের ৫-১০ টাকা বেশি দিয়ে পাট ও চটের ব্যাগ দোকানে রাখতে হবে অথবা ক্রেতাদের সঙ্গে করে ব্যাগ আনতে হবে। পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে সবাই মিলে।
পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ নিয়ে বহুদিন থেকেই চলছে আলোচনা। যদিও এ ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসতে পারেনি। এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট সচিব আব্দুর রউফ বলেন, সোনালি ব্যাগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে উদ্ভাবক মোবারক আহমদ খানের আলোচনা হয়েছে। ব্যাগটির কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এ বিষয়ে অনুমতি পেলেই পাইলটিং চালু হবে।