কামরাঙ্গীরচরে তিতাসের অভিযানে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ

প্রকাশিত: ৪:১৩ পূর্বাহ্ণ, জুন ২১, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বকেয়া বিল আদায় ও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযান চালিয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার (২০ জুন) দিনব্যাপী কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদ, মাদবর বাজার, পূর্ব রসুলপুর, হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযোগ উঠেছে,  অভিযান চলাকালে তিতাস গ্যাস কোম্পানির নিয়োজিত একাধিক টিমের সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছেমত আবাসিক ভবনে তল্লাশি চালিয়ে গ্যাস রাইজার খুলে নিয়ে অধিকাংশ গ্রাহকের সাথে রফাদফার মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিজেদের পকেট ভারি করেছে। যেসব গ্রাহকের সাথে আর্থিক লেনদেনের  বিষয়ে সমঝোতা হয়নি, তিতাসের লোকজন তাদের রাইজার কেটে অফিসে রিপোর্ট করে জমা দিয়েছেন। গ্রাহকদের এমন অভিযোগ ও অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে টিমের একজন নিজেকে রিপন ও অপরজন রিপন মল্লিক বলে পরিচয় দিলেও নিজেদের পদ-পদবী এবং এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। বরং তারা উল্টো সাংবাদিকের আইডি কার্ড দেখতে চেয়ে দ্রুত টিম নিয়ে দুটি মাইক্রোযোগে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। তবে তিতাসের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা বলেছেন, এটা চলমান প্রক্রিয়া।

বকেয়া বিল আদায়ে ও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযানে মঙ্গলবার (২০ জুন) সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কামরাঙ্গীরচরে তিতাসের একাধিক টিম অভিযান চালিয়েছে। এসময় ওই এলাকায় বাসাবাড়ির ৮০টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরমধ্যে বকেয়ার কারণে ৫৯ ও অবৈধ সংযোগ ২১টি। তবে অনৈতিকভাবে টিমের কোনো সদস্য গ্রাহকের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে রাইজার ফেরত দিয়ে থাকে এবং অভিযোগের সত্যতা পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মঙ্গলবার দিনভর এলাকা ঘুরে গ্রাহক ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বকেয়া বিল আদায় ও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণে মঙ্গলবার (২০ জুন) দিনব্যাপী কামরাঙ্গীরচরের, আশ্রাফাবাদ, মাদবর বাজার, পূর্ব রসুলপুর, হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। বিশেষ এই অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন তিতাস গ্যাসের ঢাকা মেট্রোর রাজস্ব বিভাগ-৫ এর মহাব্যবস্থাপক রশিদুল আলম এবং উপমহাব্যবস্থাপক মো. তোফাজ্জল হোসেন। ১৪টি টিম একসঙ্গে এই অভিযানে অংশ নিয়ে বিল খেলাপি ও অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।

এলাকাবাসীরা জানায়, এই এলাকার ৯০ শতাংশ অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করে থাকে, এ কারণে বৈধ গ্যাস সংযোগকারীরা গ্যাস পাচ্ছেন না। বিশেষ করে এলাকায় প্রায় ৫ শতাধিক খানাডুলি (ডোলা) তৈরির কারখানা রয়েছে। যদিও এসব কারখানায় বৈধ কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। এরপরও রাতের আঁধারে একটি চক্র তিতাসের মূল সংযোগ থেকে নিম্নমানের পাইপ দিয়ে বিভিন্ন কারখানায় মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদান করে আসছে। এসব কারখানা কখনো দিনে চালু হয়না। সন্ধ্যার পরপরই ৬-৯ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইনে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে চালু করা হয় কারখানা। রাতভর চলে উৎপাদন কার্যক্রম। এসব কারখানা থেকে স্থানীয় কতিপয় চক্রের মাধ্যমে কারখানাপ্রতি ৫-১০ হাজার করে টাকা তুলে নেন তিতাসের লোকজন। খবর পেয়ে মঙ্গলবার দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে পূর্ব রসুলপুর এলাকার ৫ নম্বর গলিতে গিয়ে দেখা যায়। তিতাস গ্যাস কোম্পানির হেড অফিসে কর্মরত এক নারীর (সিরাজুল ইসলামের) মালিকানাধীন ৬ তলা বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে রয়েছেন অভিযানিক দলের সদস্যরা। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার আলেয়া বেগম। তিনি অভিযানিক দলকে জানিয়ে দেন বাড়ির মালিক নিজেই তিতাস গ্যাস কোম্পানির হেড অফিসে কারওয়ান বাজারে চাকরি করেন। স্থানীয়রা জানান, ওই বাড়িতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ থাকার পরও অভিযান চলায়নি। বরং বিপরীত পাশে হাজি সাইফুল ইসলামের ছয়তলা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বকেয়া বিল আদায়ে ও অবৈধ সংযোগ থাকায় রাইজারটি কেটে সিল মেরে যায়। এর আগে ৬ নম্বর গলির বাসিন্দা নজরুল মাস্টারসহ আরও ৩/৪টি বাড়ির রাইজার কেটে নিয়ে যায়। ৫ নম্বর গলিতে জড়ো হয়ে টিমের সদস্যদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। এরপর চুলা জ্বালানোর সংখ্যা অনুযায়ী হাজি সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার, নজরুল মাস্টারের কাছ থেকে ৫০ হাজার, আরেক জনের থেকে ৬০ হাজার, আরেক জনের কাছ থেকে ২৫ এবং ২০ হাজার টাকা রফাদফা করে বিকেল ৫টার মধ্যে যোগাযোগ করতে ভুক্তভোগী গ্রাহকের কাছে নম্বর দিয়ে পায়চারি করতে থাকেন টিমের সদস্যরা। তখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ এবং নিজেদের ইচ্ছেমত অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। এসময় একজন নিজেকে রিপন ও অপরজন রিপন মল্লিক বলে নাম বললেও নিজেদের পদ-পদবী বলতে চাননি। বলেন, যত পারেন পত্রিকায় আমাদের নামে নিউজ লিখতে থাকেন। আমাদের চাকরিও যাবে না, লিখলেও কিছুই হবেনা। এটা উপর মহলও জানেন। রিপন নিজেকে লালমাটিয়ার সোবহানবাগের অফিসে চাকরি করেন বলে দাবি করেন। এরপর তিনি পরিচয়পত্র না দেখিয়ে উল্টাে সাংবাদিকের কার্ড দেখতে চেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে দুটি মাইক্রোতে উঠে টিমসহ চলে যান। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব গ্রাহকের রাইজার ফেরত দিয়েছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, সামনে কোরবানির ঈদ। গরু কিনতে হবে, তাই টাকার জন্য ঈদের আগে এই অভিযান চালিয়েছে তিতাস গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকারের কাছে নিজেদের ভালো সাজাতে এটা একটা লোক দেখানো নাটক করেছেন তিতাসের অভিযানিক দল।

জানা গেছে, একই সময়ে পূর্ব রসুলপুর ৯ নম্বর গলির দক্ষিণপাশের বেশ কয়কটি বাড়িতে অভিযান চালয় তিতাসের আলাদা দুটি টিম। একটি টিমে রিপন মল্লিক ও এনায়েত কবির গ্রাহকদের না ডেকেই ৩টি বাড়ির রাইজার খুলে নিয়ে সিল মেরে যায়। বিকেল ৫টার দিকে বিল্লালের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে সিল খুলে রাইজার দিয়ে যায়। এই টিমের সদস্যরা নিজেদের মতিঝিল অফিসে বসেন বলে জানায়। একই সময় অপর টিমের সদস্য এনামুল একই গলির নোয়াখাইল্লার (খায়রী) খোকন মিয়ার বাড়ির রাইজার কেটে নিলেও রফাদফা করে ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে আধাঘন্টা পর তা ফেরত দিয়ে যায়। ভুক্তভোগীরা বলেন, সময় বদলেছে, গ্রাহকের চাহিদও বাড়ছে। ষেখানে টিনশেড বা দোতলা ছিল,  সেখানে এখন বহুতল ভবন হয়েছে। নতুন সংযোগ নয়, গ্যাস সম্প্রসারণই জরুরি। নতুন  করে গ্যাস সংযোগ এবং সম্প্রসারণের সুযোগ না দেয়ায় এই জ্বালানি গ্যাসখাতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অপরদিকে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অভিযানের আড়ালে বকেয়া বিল আদায়ে ও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের নামে তিতাসের মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ সদস্যরা নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিজেদের পকেট ভারি করছেন।

অভিযানের বিষয়ে তিতাসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সালেহ আহাম্মদ আলমগীর বলেন, আজ আমরা কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সকাল থেকে অভিযান চালাচ্ছি। এই এলাকায় ৯০ শতাংশ বাড়িতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করছে, তালিকা অনুযায়ী সবগুলো আমরা বিচ্ছিন্ন করছি। এদের বিরুদ্ধে আইননুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য সুপারিশ করা হবে।

অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া তিতাসের ঢাকা মেট্রোর রাজস্ব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক রশিদুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এসব এলাকায় নজর রাখছি, যতটুকু পরিমাণে গ্যাস ব্যবহার করা হয় তার চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ বিল জমা হয়।

তখন আমরা অনুসন্ধান টিম পাঠিয়ে নিশ্চিত হলাম প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িতে অবৈধ সংযোগ রয়েছে। যে কয়টি বৈধ সংযোগ আছে সেইগুলোও বিল খেলাপি করছে। কারও কারও ১০ বছরেরও অধিক সময়ের বিল বকেয়া আছে। সেই সকল বিল খেলাপি ও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে এই বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত বিল খেলাপি ও অবৈধ সংযোগ থাকবে ততদিন নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে রাতে কারওয়ান বাজারে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের বিক্রয় ও বিপণন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্রাহকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিতাস গ্যাস কোম্পানির অভিযানিক টিমের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে এবং গ্রাহকের আনিত অভিযোগের সত্যতা পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, ইতোপূর্বে তিতাসের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হওয়ায় তদন্ত করে এর সত্যতা মেলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে নতুন করে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে গ্যাস সম্প্রসারণের চাহিদা থাকলেও সরকারের নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত কোন গ্রাহককেই নতুন করে গ্যাস সংযোগ ও সম্প্রসারণ করার সুযোগ নেই।