
ক্রীড়া ডেস্ক:
যারা সুরের ভুবনে হারিয়ে থাকতে পছন্দ করেন, তারা অন্তত একবার হলেও গুনগুন করেছেন ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে’। এই রবীন্দ্র সংগীতের মতো নাজমুল হোসেন শান্তরাও মনে মনে অনেক কিছুই কল্পনা করেন। এই যেমন চলতে থাকা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তারা ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কল্পনা করেছিলেন শিরোপা তাদের হাতে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে মাঠের খেলায় কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেছেন, সেটি তারা নিজেরা ও হয়তো বলতে পারবেন না!
বৃষ্টির কল্যাণে পুরো টুর্নামেন্ট থেকে কেবল ১টি পয়েন্ট হাতে করে তারা দেশে ফিরেছেন। সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখে সবার আগে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে বিদায় নিশ্চিত করেছেন। এরপরও শান্তরা স্বপ্ন দেখেন। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, বড় হওয়ার জন্য তো বড় স্বপ্ন দেখতেই হবে। স্বপ্ন দেখতে মানা নেই। কিন্তু দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্তদের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ যখন শান্তরা হয়ে ওঠেন, তখন সেটিকে স্বাভাবিক দেখাটাই দায় হয়ে ওঠে।
প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে গিয়ে আফগানিস্তান যতটুকু রোমাঞ্চের উপহার দিয়েছে এবং লড়াই করেছে, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকা বাংলাদেশ দলও সেটি করতে পারেনি। ভারত ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন শান্তরা। পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামার সুযোগ হলে ভালো কিছু করে দেখাতেন, তার নিশ্চয়তা ছিল না। এর চেয়ে ১টি পয়েন্ট নিয়ে আরও একটি হার এড়াতে পেরেছে টাইগার বাহিনী, সেটি নিয়ে ভক্তরা মেতেছেন ট্রোলে।
ওয়ানডে ক্রিকেট বাংলাদেশ দলের শক্তির জায়গা হিসাবে বিবেচিত হতো কিছুদিন আগেও। কিন্তু এখন কোনো ফরম্যাটেই লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা জ্বলে উঠতে পারেন না। কালেভদ্রে দুই-একটি ম্যাচ কিংবা সিরিজ ভালো করলে সেটিকেই সব সময় উদাহরণ হিসেবে রাখেন ক্রিকেটাররা। ব্যর্থতা থেকে বারবার শিক্ষা নেওয়ার কথা মুখে বললেও বাস্তবে শিক্ষা নেন না ক্রিকেটাররা।
এক ব্যাটিং ব্যর্থতার শিক্ষা বাংলাদেশ দল নিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকে বের হতে পারেনি টাইগার বাহিনী। এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ব্যাটিং ব্যর্থতা এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, পুরো দল সেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুরুতে ব্যর্থতা স্বীকার করলেও এখন শান্তরা সামনে রাখছেন যেখানে যতটুকু ভালো করেছেন সেই উদাহরণ। তাতে আবারও তৃপ্তির ঢেকুর তোলার প্রেক্ষপট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ডট বল। ব্যাটাররা স্ট্রাইক ঘোরাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। দুই ম্যাচে ৩৪০টি ডট বল খেলেছেন শান্তরা। ভারতের বিপক্ষে ১৫৯ এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮১টি। যখন অন্যান্য দল ৩০০ রানের বেশি করার মানসিকতা নিয়ে ইনিংস সাজিয়েছে, তখন বাংলাদেশ একের পর এক ডট বল খেলে নিজেদের জন্যই বিপদ ডেকে এনেছে। ব্যাট হাতে সুযোগটা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন তানজিদ হাসান তামিম। নির্বাচকরা লিটন দাসের বদলে তানজিদকে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন তিনি করতে পারেননি। ভারতের বিপক্ষে ২৫ ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২৪ রান করেছেন। আধুনিক ক্রিকেটে একজন ওপেনারের এমন পারফর্ম দলের ওপরেও চাপ তৈরি করেছে।
সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে একজন অলরাউন্ডার হিসেবে মেহেদী হাসান মিরাজের ওপরে ভরসা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাট এবং বল উভয় জায়গাতেই ব্যর্থ হয়েছেন মিরাজ। কোনো ম্যাচেই তিনি উইকেট তুলতে পারেননি। চার নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে মাত্র ৫ এবং ১৩ রান করেছেন। একজন অফ-স্পিনার কতটা জরুরি দলের জন্য সেটি নিউজিল্যান্ডের মাইকেল ব্রেসওয়েল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। মিরাজ ওপরের দিকে ব্যাটিংয়ে নেমেও পেসারদের বিপক্ষে নড়বড়ে ছিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নিজেদের প্রমাণ করতে পারেননি। তাদের দুর্বল পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দলের মেরুদণ্ডে আঘাত করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন তারা কতটুকু প্রভাব রাখতে পারবেন, সেটিও এই টুর্নামেন্টের পরে আলোচনায় এসেছে।
এর বাইরে বাংলাদেশের পেস আক্রমণ সম্প্রতি প্রশংসা কুড়ালেও তারকা পেসার মোস্তাফিজুর রহমানের জাদু দেখা যায়নি। প্রতিপক্ষরা তার ধীরগতির বল এবং কাটার বেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে। রানও বের করে নিয়েছে। এই জায়গায় ফর্মে থাকা হাসান মাহমুদ থাকলে ভিন্ন ফলও আসতে পারতো। এত ব্যর্থতার ভিড়ে সাফল্যের ছোঁয়া দিয়েছেন তাওহীদ হৃদয়। তিনি ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন। এছাড়া শান্তর অর্ধশতক ও জাকের আলী অনিকের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দেখা গেলেও শক্তিশালী দলের বিপক্ষে সেটি পর্যাপ্ত ছিল না। তাতে শান্তদের দক্ষতা ও সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও তারা যেভাবে স্বপ্ন দেখেন, সেটি আসলে ভক্তদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণেরই নামান্তর।