নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
ভোটের আগে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন, নির্বাচনে ভরাডুবিতে দলে অন্তর্কোন্দল আর সবশেষ আপস করেও মন্ত্রিসভায় পদ ভাগাতে না পারা, সবমিলিয়ে টালমাটাল জাতীয় পার্টি (জাপা)। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর অংশ না নেওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে জাতীয় পার্টি এখন খাদের কিনারে, এমনটিই মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতাদের একাংশ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার আশায় বিভোর জাতীয় পার্টি ২৮৯টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল। অথচ দলের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। দলের অসহযোগিতাসহ বিভিন্ন কারণে ভোটের আগেই মাঠ ছেড়েছে শতাধিক প্রার্থী। মাঠে যারা ছিলেন তাদেরও অধিকাংশেরই হয়েছে চরম ভরাডুবি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি এবার পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। দলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগে পেয়েছে মাত্র ৩টি আসন। ঢাকায় জোটেনি একটি আসনও। দলের একাধিক প্রার্থী হারিয়েছেন জামানত। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা হলেও নতুন মন্ত্রিসভায় ঘোষিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের তালিকায় জায়গা হয়নি জাপার কোনো এমপির।
জাতীয় পার্টি এবার পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। দলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগে পেয়েছে মাত্র ৩টি আসন। ঢাকায় জোটেনি একটি আসনও। দলের একাধিক প্রার্থী হারিয়েছেন জামানত। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা হলেও নতুন মন্ত্রিসভায় ঘোষিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের তালিকায় জায়গা হয়নি জাপার কোনো এমপির
বিভিন্ন সময়ে দেশে জাতীয় নির্বাচন এলেই নানা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেওয়া জাতীয় পার্টি এবারও ব্যতিক্রম ছিল না। দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের সঙ্গে বিরোধের কারণে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদ এবার ভোটে অংশ নেননি।
ভোটে ভরাডুবির পর জাতীয় পার্টি সংসদে শপথ নেবে কি না, এ নিয়েও দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য নাটকীয়তার জন্ম দেয়। যদিও শেষ পর্যন্ত বুধবার (১১ জানুয়ারি) একাদশ সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির নবনির্বাচিত ১১ সংসদ সদস্য দ্বাদশ সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছেন।
শপথগ্রহণ শেষে জিএম কাদের জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বিরোধীদলে ছিলাম এবং বিরোধীদলেই থাকতে চাই। জাতীয় পার্টি জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দল, জনগণের জন্য যেটা ভালো হয়, আমরা সেটিই করতে চাই।
এদিকে, নির্বাচনে জাপার ভরাডুবির জন্য দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দোষারোপ করছেন জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের একটি অংশ। তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অভিযোগ, ভোটের মাঠে দলের প্রার্থীদের কোনো সহযোগিতা করেননি জাপার হাইকমান্ড।
অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বুধবার (১০ জানুয়ারি) সকালে বনানীতে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন জাপার বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। পরে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে জাপা কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপাসহ একাধিক নেতা। একপর্যায়ে কার্যালয়ের ভেতর দেখা দেয় উত্তেজনা৷ উত্তেজিত নেতারা জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্লোগান দেন। তাদের ‘দালাল’ আখ্যা দিয়েও স্লোগান দিতে দেখা যায়।
রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু তিনি পার্টির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে দেননি। অথচ পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের গত চার বছরে তার সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অদূরদর্র্শিতা এবং অদক্ষতার কারণে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
এসময় জাপার শীর্ষ নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু, জহিরুল আলম রুবেল, লিয়াকত হোসেন খোকা, মীর আবদুস সবুর আসুদ ও সুনীল শুভ রায় প্রমুখ। পরে তাদের কার্যালয়ের বাইরে বের করে আনেন পুলিশ সদস্যরা৷
ওইদিন দুপুরে শফিকুল ইসলাম সেন্টুর সমর্থকরা দুটি বাসে করে বনানী কার্যালয়ে আসেন৷ এরপর আসেন জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা৷ জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে করে সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, দলকে রক্ষা করা এবং পার্টির ঐক্য বজায় রাখার জন্য আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জিএম কাদের এবং মুজিবুল হক চুন্নুকে পদত্যাগ করতে হবে।
জাতীয় পার্টির নতুন কাউন্সিলের ঘোষণা দিয়ে টেপা বলেন, এই পর্যায়ে গঠনতান্ত্রিকভাবে পার্টিতে একজন ভারপ্রাপ্ত বা নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিয়োগ করে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। এখন একান্ত প্রয়োজনে কিছু রদবদল ছাড়া পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য পদগুলোতে অধিষ্ঠিত নেতারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন।
নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক অনিয়ম হয়েছে অভিযোগ করে সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, দলের অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ কেলেঙ্কারিসহ নির্বাচনে ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। জাতীয় পার্টির যেসব প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, আগামীতে তাদের মূল্যায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন তার সঙ্গে প্রার্থী মনোনয়ন প্রশ্নে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু তিনি পার্টির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতে দেননি। অথচ পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের গত চার বছরে তার সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অদূরদর্র্শিতা এবং অদক্ষতার কারণে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
পার্টি চেয়ারম্যান ও মহাসচিব গত এক মাস আমাদের অন্ধকারে রাখলেন। ভোটের আগে তারা বললেন, কী নাকি কৌশল আছে? কী সেই কৌশল তা আমাদের বললেন না। সেই কৌশল কি আমাদের পানিতে ফেলে দেওয়া? ভোটে ভরাডুবির পর রাজনীতিতে জাপার অবস্থান আরও নিচে নেমে গেছে
সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, সব নেতাকর্মীকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ ভোটের সময় প্রার্থীদের কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি৷ কারও সঙ্গে কথা না বলে কেবল তিন-চারজন মিলে আসন সমঝোতার বৈঠক হয়েছে। এটা অনৈতিক ও অন্যায়৷ আমরা ক্ষুব্ধ।
জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে যখন এই উত্তেজনা চলছিল তখন সংসদে শপথ নিচ্ছিলেন জাপার নবনির্বাচিত ১১ এমপি। শপথগ্রহণ শেষ হওয়ার পর বিকেল পর্যন্ত দলের কোনো শীর্ষ নেতাকে বনানী কার্যালয়ে যেতে দেখা যায়নি।
তবে দলের নেতাকর্মীদের এই বিক্ষোভ বা অসন্তোষ প্রকাশের বিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সাড়া দেননি৷
নেতৃত্বে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেন, এগুলো সাজানো জিনিস। কিছু লোক আমাদের পার্টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। যা কিছু করা হয়েছে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই করা হয়েছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৩ ও ঢাকা-১৪ আসনে দলের প্রার্থী হলেও পরে সরে দাঁড়ান জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পর দলের কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ তোলেন তিনি।
শফিকুল ইসলাম সেন্টু গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, পার্টি চেয়ারম্যান ও মহাসচিব গত এক মাস আমাদের অন্ধকারে রাখলেন। ভোটের আগে তারা বললেন, কী নাকি কৌশল আছে? কী সেই কৌশল তা আমাদের বললেন না। সেই কৌশল কি আমাদের পানিতে ফেলে দেওয়া?
ভোটে ভরাডুবির পর রাজনীতিতে জাপার অবস্থান আরও নিচে নেমে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, সমঝোতার ২৬টি আসনের সবকটিতে জিততে পারলাম না৷ দল জিরোতে নেমে গেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় জেল-জুলুমের মধ্যেও জাপা ৩৫টি আসনে জয় পেয়েছিল। ধীরে ধীরে সে আসন সংখ্যা কেন কমছে, আমরা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে জিজ্ঞাসা করবো৷