খামারবাড়িতে পদায়ন বদলির রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ৩:৪৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩০, ২০২৫

সেলিনা আক্তার:

সারাদেশে আধুনিক কৃষি ও ফসল বিস্তারের দায়িত্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), যা ফার্মগেটের খামারবাড়ি নামে পরিচিত। আওয়ামী লীগের পতনের পরও দুর্নীতির তকমা মুছতে পারেনি অধিদপ্তর। বেড়েছে অস্থিরতা। চেয়ার দখলে মরিয়া একশ্রেণির কর্মকর্তা, পেশাজীবী সংগঠন ও বিএনপিপন্থি কৃষিবিদ নেতারা।

রীতিমতো তালিকা করে বদলি বাণিজ্যে নেমেছেন তারা। নিজের বদলি, আবার আদেশের পর বদলি ঠেকাতে অনেকেই দ্বারস্থ হচ্ছেন তাদের। চাপ দিয়ে কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে নিচ্ছেন পদায়ন। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে ঢালছেন টাকা। বদলি-পদায়ন বাণিজ্যের পাশাপাশি নানা অনুষ্ঠানের নামে চলছে চাঁদাবাজিও। পুরোনো কর্মকর্তাদের সরাতে করা হচ্ছে হয়রানি। কখনও খুনি আখ্যা দিয়ে ব্যানার টানানো; হত্যাচেষ্টা মামলা আবার কখনও মন্ত্রণালয়-দুদকে অভিযোগ দিচ্ছে। শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটের কাছে মহাপরিচালকও অসহায়। খামারবাড়ির এমন অস্থিরতায় মাঠের কার্যক্রমে হযবরল।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কৃষির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর চলছে দুর্বল নেতৃত্বে। ফলে উৎপাদন হ্রাস ও উপকরণ সংকটে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাঠে মাঠে বদলি আতঙ্ক

রবি মৌসুমে মাঠ পর্যায়ে কাজের চাপের কারণে নেহাত দরকার না পড়লে বদলির আদেশ হয় না। কিন্তু এবার একের পর এক বদলির আদেশ হচ্ছে। ডিএইর ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বদলির শেষ আদেশটি জারি হয়েছে গত বছর ১৭ নভেম্বর। অথচ এর পর ৮ ডিসেম্বর ১২ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বদলি করা হলেও দেওয়া হয়নি ওয়েবসাইটে। একইভাবে ৩০ ডিসেম্বর মাঠ পর্যায়ের ১১ কর্মকর্তাকে সুবিধাজনক স্থানে সংযুক্তিতে পদায়ন করার আদেশও গোপন রাখা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে ডিএই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করেছে। শুধু যশোর অঞ্চলেই এক মাসে বদলি করা হয় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আজগর আলী চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার আগে এ বদলি করেন।

আদেশ বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থের বিনিময়ে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ বাড়ির কাছে বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য তাদের এ সুবিধা দিতে গিয়ে অন্যদের দূরে পাঠানো হয়েছে। বদলির ক্ষেত্রে মানা হয়নি নিয়মও। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলিতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও জেলা কর্মকর্তার সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। হর্টিকালচার সেন্টারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করতে হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালকের সঙ্গে আলোচনার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে কৃষিবিদদের বিভিন্ন সংগঠন, বিএনপির বেশ কয়েক নেতা, পেশাজীবী সংগঠন ও কর্মকর্তাদের একটি চক্র সারাদেশেই বদলি বাণিজ্যে জড়িয়েছেন। বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘আওয়ামী লীগের’ দোসর আখ্যা দিয়ে বদলির ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। ‘জনস্বার্থে’ এ বদলিতে কর্মস্থলভেদে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়েছে। উপঢৌকন দিয়ে কেউ কেউ ভালো পদে বসেছেন; আবার চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেকেই যেতে পারছেন না কাঙ্ক্ষিত কর্মস্থলে। অবশ্য কারও কারও জনস্বার্থে বদলির মতো সোনার হরিণ ভাগ্যে জুটেছে ‘মামার জোরে’। যাঁর যত সমস্যা, তাঁকে ঘুষের অঙ্কও গুনতে হচ্ছে বেশি। চাহিদা অনুযায়ী টাকা এবং গোপনীয়তার নিশ্চয়তা পেলে আদেশ অনুমোদন হয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্ব পায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি সম্প্রসারণ

অধিদপ্তরের প্রশাসন উইংয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বেশির ভাগ বদলি-পদায়ন প্রশাসন উইংয়ের হাতে নেই। অনেকেই বিএনপি নেতাদের মাধ্যমে তদবির করছেন। আবার কেউ কেউ কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও পছন্দের পদে বসছেন। বদলি বাণিজ্য খামারবাড়ির বাইরেই হচ্ছে বেশি। ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিয়ে প্রশাসন উইংকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সাধারণত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সুপারিশের পর মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উইংয়ের পরিচালকদের পদায়ন করে। কিন্তু সম্প্রতি ডিএইর প্রশাসন, অর্থসহ ছয়টি উইংয়ে পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও, এ জন্য মহাপরিচালক কোনো সুপারিশ করেননি। যাদের এসব পদে বসানো হয়েছে, তাদের মধ্যে দু-একজনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।

কৃষি কর্মকর্তাদের কার্যক্রম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকেন্দ্রিক হলেও তাদের বদলি কিংবা পদায়ন করে কৃষি মন্ত্রণালয়। যে কারণে এ সেক্টরে সঠিক মূল্যয়ন না হওয়া এবং দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ রয়েছে। নবম থেকে পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত সব কর্মকর্তার বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপিপন্থি এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি তকমা দিয়ে হাজারো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই অবসরে গেছেন। রাজনৈতিক কারণে হয়রানির শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এখন তাদের মূল্যায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এখনও আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারাই বহাল আছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিচ্ছে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের উপপরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুর রশীদ বলেন, বিগত ছয় মাসে স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি হয়েছেন। এ নিয়ে অনিয়মের কোনো খবর আসেনি। মাঠ পর্যায়ে নীতিবহির্ভূত কোনো বদলি হলে খতিয়ে দেখা হবে।

এ ব্যাপারে ডিএইর মহাপরিচালক সাইফুল আলমের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।

পিডি পদে বসতে তদবির

৩১ প্রকল্পের মাধ্যমে ডিএই সারাদেশে নানা কার্যক্রম ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হতে কিছু কর্মকর্তা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

১৫ প্রকল্পের পরিচালককে সরাতে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ পাঠিয়েছেন ডিএইর মহাপরিচালক। আর সেই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় সভা করেছে। এতে সাত প্রকল্প পরিচালক সরিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তটি এখন কৃষি উপদেষ্টার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক এবং মাঠ পর্যায়ে কোনো অভিযোগ না থাকার পরও পরিচালককে সরানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রকল্প পরিচালকদের সরাতে বিএনপিপন্থি বিভিন্ন গ্রুপের চাপ ছিল দীর্ঘদিন। মন্ত্রণালয় অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রকল্প পরিচালকদের সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কারণে প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের প্রয়োজন হলেও তা খুব সতর্কতার সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী করার বিধান রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের মাঝপথে পরিচালক পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে কৃষিতে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

প্রকল্প পরিচালক পদে তদবিরের বিষয়টি উঠে আসে খোদ কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কণ্ঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে এক সভায় কৃষি উপদেষ্টা বলেছেন– প্রকল্প পরিচালক পদে বসতে যারা তদিবর বাণিজ্য করছেন, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন নিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের জন্য এর আগে ৭৬ কর্মকর্তাকে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। যার মধ্যে নিজেদের দলভুক্ত কয়েকজন বাদে অধিকাংশ প্রকল্প পরিচালককে এ মামলায় আসামি করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, খামারবাড়িকেন্দ্রিক একটি চক্র প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের জন্য ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকার চুক্তি করেছে। প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুল আলম স্বাক্ষরিত প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে হাতে হাতে। দাপ্তরিক চিঠি অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে ই-নথির মাধ্যমে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও, হাতে হাতে ফাইল হস্তান্তর হয়।

পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, অধিকাংশ প্রকল্পের পরিচালক প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির আগ থেকে কাজ করছেন। প্রকল্প প্রস্তাবনা তাদের হাতেই তৈরি হয়েছে। ফলে হুট করে প্রকল্প পরিচালকদের সরিয়ে দিলে কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ নীতিমালা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রকল্প পরিচালক পদে যাদের বসানো হবে, তারা যোগ্য কিনা, তাও দেখা দরকার।

সম্প্রতি কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী খামারবাড়ি পরিদর্শন করেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, দুর্নীতিকে কোনো ধরনের প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কোনো দুর্নীতিবাজের জন্য কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না।