
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
সাত মাসে মব ভায়োলেন্সে নিহত ১১৯ জন
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণ ৯৬ জন
রাজনৈতিক সহিংসতায় দুই মাসে খুন ১৬
জানুয়ারি মাসেই সারা দেশে খুন ২৯৪
সম্প্রতি দেশে প্রকাশ্যে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। এতে দেশ জুড়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শহরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ কেউ কেউ অন্তর্র্বতী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন। যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি বিশেষ অভিযানের মধ্যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
গত দুই মাসে রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই ও আঞ্চলিক মহাসড়কে বাস ডাকাতির মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় এসেছে। সমসাময়িক বেশকিছু হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্থানীয় মানুষ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা, গণপিটুনিতে হত্যা, বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করারও ঘটনা রয়েছে। পুরো পরিস্থিতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের আতঙ্ক।
মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাত মাসে মব ভায়োলেন্স তৈরি করে ১১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন নারী ও শিশু। একই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৬ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গত জানুয়ারিতে খুন হয়েছেন ২৯৪ জন। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে খুন হয়েছিলেন ২৩১ জন।
বেড়েছে খুন :সর্বশেষ রাজধানীর উত্তরখান থানাধীন পুরানপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন শান্তিনগরের হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের উপাধ্যক্ষ সাইফুর রহমান ভুঁইয়া। গত সোমবার ভোরের দিকে কোনো এক সময় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনারের দায়িত্বে থাকা আহাম্মদ আলী জানান।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় পল মজুমদার খোকন নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় খোকনের ছেলে পিয়াস মজুমদারকে হাত-পা বেঁধে হত্যা করে সব নিয়ে যায় ডাকাতরা। খোকন একজন দন্তচিকিৎসক ও তার স্ত্রী অনিতা বৈদ্য একজন নার্স। এর আগে শনিবার মাদারীপুরে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত সাইফুল সরদার ছিলেন মাদারীপুরের খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সাইফুলের অপর দুই ভাই হলেন, আতাউর সরদার (৪০) এবং চাচাতো ভাই পলাশ সরদার (১৫)। এই ধরনের অপরাধের ঘটনা এখন প্রতিদিনই ঘটছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ অগাস্ট থানা থেকে অস্ত্র লুট এবং জেল থেকে অপরাধী ও সন্ত্রাসীরা অনেকে বেরিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি নাজুক হলে কেউ কেউ সুযোগ নিচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নানা ধরনের ঘোষণা দিয়ে কাজ করা হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত জানুয়ারিতে দেশে খুন হয়েছেন ২৯৪ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ২৩১ জন। অর্থাৎ খুন বেড়েছে ৬৩টি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৬ জন।
ধর্ষণও বেড়েছে :এর মধ্যে মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। গত দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) ২৯৪ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন এবং এর মধ্যে ৪৪ জন শিশু রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ নারী (ধর্ষণের সংখ্যা ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা ১৮টি) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ওয়েবসাইট ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শুধু গত ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী, অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী ইত্তেফাককে বলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের সময় প্রতিকারের একটা চেষ্টা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু অন্তর্র্বতী সরকারের মধ্যে সেই ধরনের কোনো চেষ্টাও নেই। বরং কখনো কখনো নিপীড়কদের পুনর্বাসন আমরা দেখতে পাচ্ছি। যা নারীর অধিকারের পথে প্রধান অন্তরায়।’
গণপিটুনিতে নিহত ১১৯ :অন্তর্র্বতী সরকারের সাত মাসে দেশে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন। আজ বুধবার মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এসব তথ্য জানিয়েছে।
সম্প্রতি গণপিটুনির মাধ্যমে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসবের বাইরে ধর্মীয় অবমাননা এবং ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় এ ধরনের ঘটনা থামছে না।
এইচআরএসএসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে গত বছরে। গত বছর গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৭৯ জন। আহত হয়েছেন ৮৮ জন। গত বছরের মতো গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটেছে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে। এই দুই বছর গণপিটুনিতে ২৩২ জন নিহত হন।
বেপরোয়া ডাকাতি ও ছিনতাই :গত ছয় মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি পর্যন্ত ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪৫টি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। তারা মানুষকে জিম্মি করে, অস্ত্র ঠেকিয়ে, গুলি করে অথবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতাবোধ ও আতঙ্ক। সর্বশেষ রাজধানীর বনশ্রীতে বাসায় ফেরার সময় এক সোনা ব্যবসায়ীকে গুলি ও কুপিয়ে জখম করে স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনার ভিডিও চিত্র ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আতঙ্ক তৈরি হয়।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিককালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৯টি বেশি (৬৯ শতাংশ)। ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় গত ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৫টি (৭০ শতাংশ) বেশি। সব মিলিয়ে গত আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪৫টি, যা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের তুলনায় ৩৮২টি বেশি (৫০ শতাংশ)।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘অপরাধ পরিস্থিতির উন্নতির অন্যতম নির্দেশক হলো—মানুষ ঘরে বাইরে কিংবা চলাচলে নিরাপদ বোধ করছে কি না। মানুষ এখন নিরাপদ বোধ করছে না। পরিস্থিতির উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
‘অল আউট অ্যাকশনে’ যাচ্ছে ডিবি :সম্প্রতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সবাই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণ, খুন, লুট ও ডাকাতি খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। তবে এবার আরও কঠোর হচ্ছে অন্তর্র্বতী সরকার। ‘অপরাধী যেই হোক, ছাড় না দেওয়া’ নীতিতে কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নৈরাজ্য রুখতে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে পুলিশ ও র্যাব। ‘অল আউট অ্যাকশনে’ যাচ্ছে ডিবি। সরকারের কঠোর হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছিল গত রবিবার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বৈঠক শেষে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে।
ঐ ব্রিফিংয়ে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছিলেন, ‘দেশে যেই ঘটনা এখন চলছে এর সঙ্গে জড়িতরা যে ধর্ম, মত বা পথের হোক না কেন, কেউ ছাড় পাবে না। সরকার এত দিন বিষয়টি সহ্য করলেও আজ থেকে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে।’ অপরাধীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘অপরাধীদের ধরতে আরও কঠোর হবে ডিএমপি।’