গণরুমের প্রেমবিলাস: রক্তাক্ত ক্যাম্পাসের জীবন্ত আখ্যান

প্রকাশিত: ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫

সানজিদা মাহবুবা:

তরুণ কথাসাহিত্যিক রেজাউল ইসলামের ‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসটি হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে বহুদিন পর আবার যেন আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রাণের ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে। উপন্যাসটির শুরুতেই তুহিন-মাহিরার নাটকীয় ভঙ্গির রোমান্টিক কথোপকথন আমাকে ক্রমেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল গল্পের গভীরে। তাদের দু’জনের মধ্যকার জীবনঘনিষ্ঠ আলাপে কোনো রকম কৃত্রিমতার ছাপ না থাকায় সবকিছুই মনে হচ্ছিল বাস্তবে ঘটছে। এখানেই লুকিয়ে আছে তরুণ এই লেখকের মুনশিয়ানা। একজন সার্থক লেখকই কেবল পারেন তার লেখনী দিয়ে কল্পনাকে বাস্তবের মতো করে ফুটিয়ে তুলতে। তাঁর সৃষ্ট তুহিন-মাহিরা জুটির অনবদ্য ও অকৃত্রিম কথোপকথন পড়তে পড়তে আমার কল্পনায় আসে ক্যাম্পাসের উন্মুক্ত সবুজ চত্বর, শাহবাগ থেকে কলাভবন, আর কলাভবন থেকে নীলক্ষেতের ব্যস্ততম সেই সড়কপথ।

উপন্যাসটির শুরুতে তুহিন-মাহিরার প্রাণবন্ত রোমান্টিক আলাপ আমাকে রোমান্টিসিজমের নৈসর্গিক ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও আস্তে আস্তে সেই আনন্দযাত্রা বিষাদে রূপান্তরিত হতে থাকে, যখন তুহিন ও তার সহপাঠী হাসানের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের করুণ কাহিনি চলে আসে। আসলে শুরুতে নির্ভেজাল প্রেমের উপন্যাস মনে হলেও বাস্তবে এটি বিষাদে ভরপুর একটি রাজনৈতিক আলেখ্য। বস্তুত এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যুগ যুগ ধরে চলে আসা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির অশুভ চরিত্র। লেখক এখানে ক্যাম্পাসের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দ্বারা তুহিন ও হাসানের ওপর চালানো নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র দিয়ে মূলত ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের একটি সামগ্রিক অবস্থা আঁকার চেষ্টা করেছেন।

ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী শক্তির ছাত্র সংগঠনের নেতাদের তৈরি ‘গণরুম’, ‘গেস্টরুম’ ও টর্চার সেলের অব্যক্ত ও নিষিদ্ধ গল্পগুলোকে জনসমক্ষে আনতেই তিনি মূলত এই উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ করেছেন। ‘নিষিদ্ধ’ গল্প এ জন্য বলছি, কারণ এ দেশের সাহিত্যাঙ্গনে এ ধরনের অতি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে সেভাবে সাহিত্য রচনা হয় না। কিন্তু লেখক এখানে কোনোরূপ রাখঢাক ছাড়াই সেসব নির্যাতনের চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নির্যাতনের হুবহু বর্ণনা তুলে ধরতে তিনি এই বইয়ে ছাত্রনেতাদের কিছু অশ্লীল ও অশালীন শব্দ চয়ন করেছেন, যা হয়তো ক্ল্যাসিক সাহিত্যের মানদণ্ডে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না, তবে একটি ঘটনার অবিকৃত ও অবিকল চিত্র অঙ্কন করতে এ ধরনের শব্দ চয়ন যথার্থ বলেই আমি মনে করি।

‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়েছে। কারণ সে উপন্যাসেরও প্রধান বিষয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের হাতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়ন। ড. আসিফ নজরুলই সম্ভবত প্রথম কোনো বাংলাদেশি লেখক, যিনি আমাদের দেশের ক্যাম্পাসগুলোর ছাত্র রাজনীতির এই ফ্যাসিবাদী চরিত্র সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। দুটি উপন্যাসের গল্প ঘুরেফিরে একই, তাদের চরিত্র কেবল আলাদা। ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসের মিনহাজ আর ‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসের তুহিন ও হাসানের ভাগ্য প্রায় একই সুতায় গাঁথা। এই তিনজনই ফ্যাসিবাদের রক্তপিপাসু ছাত্র রাজনীতির জিঘাংসার শিকার। এ ছাড়াও ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটি পড়ে পাঠকরা আগেই জানতে পেরেছেন যে পেশি শক্তিনির্ভর ফ্যাসিবাদী শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকেও মৃত্যু হুমকি থেকে রেহাই পান না। ঠিক একইভাবে ‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসটি পড়েও পাঠক জানতে পারবেন, ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে কীভাবে উগ্রবাদী ছাত্রনেতারা খাবার টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিরীহ ও নির্দোষ শিক্ষার্থীকে অমানবিক নিপীড়ন ও নির্যাতন করে!

গণরুমের প্রেমবিলাস– এ ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা, সঠিক শব্দ চয়ন, প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন তৈরিতে ক্ল্যাসিক সাহিত্যের ব্যবহার, গল্পের প্রবহমানতা, নাটকীয় ভঙ্গিতে গল্পের শুরু ও সমাপ্তি– এ সবকিছুই আমাকে চমৎকৃত করেছে। তবে উপন্যাসের প্রধান প্রধান চরিত্র যেমন– তুহিন, মাহিরা ও হাসানের চরিত্র চিত্রণ আমার কাছে অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়েছে। এই চরিত্রগুলোকে আরও নিখুঁতভাবে ও বৃহৎ পরিসরে ফুটিয়ে তোলার অবকাশ ছিল। এ ছাড়াও এই উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র মাহিরার নামের প্রতি সেভাবে সুবিচার করা হয়নি, যেভাবে আসলে করার কথা ছিল। উপন্যাসটির হাসান-নবনীতা জুটির অপূর্ণাঙ্গ চরিত্র চিত্রায়ণও চোখে পড়ার মতো। তবে সার্বিক বিচারে আমার কাছে মনে হয়েছে বইটি পাঠকদের হৃদয়ে তার মুখ্য বার্তাটি ভালোভাবে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।

গণরুমের প্রেমবিলাস: রক্তাক্ত ক্যাম্পাসের জীবন্ত আখ্যান

তরুণ কথাসাহিত্যিক রেজাউল ইসলামের ‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসটি হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে বহুদিন পর আবার যেন আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রাণের ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে। উপন্যাসটির শুরুতেই তুহিন-মাহিরার নাটকীয় ভঙ্গির রোমান্টিক কথোপকথন আমাকে ক্রমেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল গল্পের গভীরে। তাদের দু’জনের মধ্যকার জীবনঘনিষ্ঠ আলাপে কোনো রকম কৃত্রিমতার ছাপ না থাকায় সবকিছুই মনে হচ্ছিল বাস্তবে ঘটছে। এখানেই লুকিয়ে আছে তরুণ এই লেখকের মুনশিয়ানা। একজন সার্থক লেখকই কেবল পারেন তার লেখনী দিয়ে কল্পনাকে বাস্তবের মতো করে ফুটিয়ে তুলতে। তাঁর সৃষ্ট তুহিন-মাহিরা জুটির অনবদ্য ও অকৃত্রিম কথোপকথন পড়তে পড়তে আমার কল্পনায় আসে ক্যাম্পাসের উন্মুক্ত সবুজ চত্বর, শাহবাগ থেকে কলাভবন, আর কলাভবন থেকে নীলক্ষেতের ব্যস্ততম সেই সড়কপথ।

উপন্যাসটির শুরুতে তুহিন-মাহিরার প্রাণবন্ত রোমান্টিক আলাপ আমাকে রোমান্টিসিজমের নৈসর্গিক ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও আস্তে আস্তে সেই আনন্দযাত্রা বিষাদে রূপান্তরিত হতে থাকে, যখন তুহিন ও তার সহপাঠী হাসানের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনের করুণ কাহিনি চলে আসে। আসলে শুরুতে নির্ভেজাল প্রেমের উপন্যাস মনে হলেও বাস্তবে এটি বিষাদে ভরপুর একটি রাজনৈতিক আলেখ্য। বস্তুত এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যুগ যুগ ধরে চলে আসা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির অশুভ চরিত্র। লেখক এখানে ক্যাম্পাসের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দ্বারা তুহিন ও হাসানের ওপর চালানো নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র দিয়ে মূলত ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের একটি সামগ্রিক অবস্থা আঁকার চেষ্টা করেছেন।

ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী শক্তির ছাত্র সংগঠনের নেতাদের তৈরি ‘গণরুম’, ‘গেস্টরুম’ ও টর্চার সেলের অব্যক্ত ও নিষিদ্ধ গল্পগুলোকে জনসমক্ষে আনতেই তিনি মূলত এই উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ করেছেন। ‘নিষিদ্ধ’ গল্প এ জন্য বলছি, কারণ এ দেশের সাহিত্যাঙ্গনে এ ধরনের অতি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে সেভাবে সাহিত্য রচনা হয় না। কিন্তু লেখক এখানে কোনোরূপ রাখঢাক ছাড়াই সেসব নির্যাতনের চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নির্যাতনের হুবহু বর্ণনা তুলে ধরতে তিনি এই বইয়ে ছাত্রনেতাদের কিছু অশ্লীল ও অশালীন শব্দ চয়ন করেছেন, যা হয়তো ক্ল্যাসিক সাহিত্যের মানদণ্ডে উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না, তবে একটি ঘটনার অবিকৃত ও অবিকল চিত্র অঙ্কন করতে এ ধরনের শব্দ চয়ন যথার্থ বলেই আমি মনে করি।

‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়েছে। কারণ সে উপন্যাসেরও প্রধান বিষয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের হাতে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়ন। ড. আসিফ নজরুলই সম্ভবত প্রথম কোনো বাংলাদেশি লেখক, যিনি আমাদের দেশের ক্যাম্পাসগুলোর ছাত্র রাজনীতির এই ফ্যাসিবাদী চরিত্র সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। দুটি উপন্যাসের গল্প ঘুরেফিরে একই, তাদের চরিত্র কেবল আলাদা। ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসের মিনহাজ আর ‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসের তুহিন ও হাসানের ভাগ্য প্রায় একই সুতায় গাঁথা। এই তিনজনই ফ্যাসিবাদের রক্তপিপাসু ছাত্র রাজনীতির জিঘাংসার শিকার। এ ছাড়াও ‘আমি আবু বকর’ উপন্যাসটি পড়ে পাঠকরা আগেই জানতে পেরেছেন যে পেশি শক্তিনির্ভর ফ্যাসিবাদী শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকেও মৃত্যু হুমকি থেকে রেহাই পান না। ঠিক একইভাবে ‘গণরুমের প্রেমবিলাস’ উপন্যাসটি পড়েও পাঠক জানতে পারবেন, ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে কীভাবে উগ্রবাদী ছাত্রনেতারা খাবার টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে নিরীহ ও নির্দোষ শিক্ষার্থীকে অমানবিক নিপীড়ন ও নির্যাতন করে!

গণরুমের প্রেমবিলাস– এ ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা, সঠিক শব্দ চয়ন, প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন তৈরিতে ক্ল্যাসিক সাহিত্যের ব্যবহার, গল্পের প্রবহমানতা, নাটকীয় ভঙ্গিতে গল্পের শুরু ও সমাপ্তি– এ সবকিছুই আমাকে চমৎকৃত করেছে। তবে উপন্যাসের প্রধান প্রধান চরিত্র যেমন– তুহিন, মাহিরা ও হাসানের চরিত্র চিত্রণ আমার কাছে অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়েছে। এই চরিত্রগুলোকে আরও নিখুঁতভাবে ও বৃহৎ পরিসরে ফুটিয়ে তোলার অবকাশ ছিল। এ ছাড়াও এই উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র মাহিরার নামের প্রতি সেভাবে সুবিচার করা হয়নি, যেভাবে আসলে করার কথা ছিল। উপন্যাসটির হাসান-নবনীতা জুটির অপূর্ণাঙ্গ চরিত্র চিত্রায়ণও চোখে পড়ার মতো। তবে সার্বিক বিচারে আমার কাছে মনে হয়েছে বইটি পাঠকদের হৃদয়ে তার মুখ্য বার্তাটি ভালোভাবে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।