গাজায় অঙ্গহীনদের অন্তহীন কষ্ট

সাড়ে চার হাজার মানুষের কৃত্রিম পা লাগানো প্রয়োজন

প্রকাশিত: ১২:০৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২৫

ডেস্ক রিপোর্ট:

 

ফারাহ আবু কায়নাসের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার। গত বছর ইসরায়েলের হামলায় এ তরুণী এতটাই আহত হন যে, শেষ পর্যন্ত বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়, যা তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে অনিশ্চয়তায় ফেলে। এর মধ্য দিয়ে ২১ বছরের ফারাহ গাজার হাজার হাজার অঙ্গহারা মানুষের তালিকায় যুক্ত হলেন। তিনি এখন একটি অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে থাকেন। নিজ এলাকায় একটি ফিজিওথেরাপি কেন্দ্রেও যাওয়া আসা করছেন, যেখানে তাঁকে একটি কৃত্রিম পা দেওয়া হতে পারে বলে আশা করছেন।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার এক সময়ের প্রাণোচ্ছল তরুণী ফারাহ বলেন, ‘ওই দিন আমি পায়ের চেয়েও বেশি কিছু হারিয়েছিলাম। আমার স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এভাবে আহত হওয়ায় আমার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেছে।’

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ জন নিহত হওয়ার পর শুরু হয় গাজায় হামলা। এতে এ পর্যন্ত ৫০ হাজার বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি। গাজার উপকূলীয় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হন ২০ লাখের বেশি মানুষ। ইসরায়েলের হামলায় গাজার পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অঙ্গ হারান হাজার হাজার মানুষ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ বলছে, পুরো গাজায় আনুমানিক সাড়ে চার হাজার মানুষের কৃত্রিম পা লাগানো প্রয়োজন। আর যে দুই হাজার বাসিন্দা কৃত্রিম হাত-পা পেয়েছেন, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। গাজায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) শারীরিক পুনর্বাসন কর্মসূচি পরিচালক আহমেদ মুসা বলেন, তাদের কর্মসূচিতে কমপক্ষে ৩ হাজার জনকে নিবন্ধিত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১ হাজার ৮০০ জনের অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে। ওসিএইচএ এবং আইসিআরসি অনুসারে আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মেরুদণ্ডের আঘাতে ভুগছেন, অথবা দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।

যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত হওয়ায় চিকিৎসা দেওয়ার প্রচেষ্টা ধীর ও জটিল হয়ে উঠেছে। আইসিআরসির কর্মকর্তারা জানান, গাজা উপত্যকায় কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পৌঁছানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসা বলেন, সঠিক কৃত্রিম অঙ্গ বা চলাচলের উপকরণ পাওয়া এখন ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে পুনরায় হামলা শুরুর পর এক মাসের বেশি সময় ধরে গাজায় কোনো ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। পা হারানো ফারাহ বলেন, তিনি জানেন না কখন কৃত্রিম পা পাবেন বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাবেন।

ইসরায়েলের হামলার সবচেয়ে বড় শিকার গাজার বেসামরিক মানুষ। তাদের মধ্যে সাত বছরের শাজা হামদান রয়েছে। সে সাইকেল চালানো শিখতে চেয়েছিল। শাজা বলছে, ‘আমার বাবা আমাকে হাঁটতে যেতে বলেছিলেন। তারপর বৃষ্টির মতো আমাদের ওপর গোলা পড়তে শুরু করল। একটি আমার পায়ে আঘাত করে, যার ফলে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আরেকটি গোলা আমার বাবার বাহুতে আঘাত করে।’

শাজার দুবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। প্রদাহের কারণে আহত পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সাজা বলছে, ‘আমি মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। তিনি আমার জন্য সবকিছু করেন। আমার জীবন আগের চেয়েও খারাপ। আহত হওয়ার আগে আমি খেলতে পারতাম।’

তার বাবা করিম হামদান জানান, শাজার মানসিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে গেছে। কারণ সে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গাজায় কোনো কৃত্রিম অঙ্গ নেই। একমাত্র সমাধান হলো গাজার বাইরে চিকিৎসার জন্য যাওয়া। মেয়েটি অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অনেক প্রশ্ন করছে; প্রতিদিন কাঁদছে।’

যুদ্ধের সময় গাজায় বেশ কয়েকটি চিকিৎসা মিশনের নেতৃত্ব দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ইসমাইল মেহের বলেন, পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে আরও অনেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারাতে পারে। ৯৯ শতাংশেরও বেশি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে নিম্নমানের পরিস্থিতিতে। সঠিক জীবাণুমুক্তকরণ ও সরঞ্জামের অভাবের কারণে চিকিৎসকদের দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। কখনও এমন চিকিৎসক দ্বারা এ কাজ করানো হচ্ছে, যিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞই নন।