
ডেস্ক রিপোর্ট:
* ইসরায়েলের ৩৬টি হামলায় শুধু নারী ও শিশু নিহত: জাতিসংঘের বিশ্লেষণ
* যুদ্ধের প্রতিবাদ করা সেনাদের বরখাস্তের ঘোষণা ইসরায়েলের
গাজায় মানবিক পরিস্থিতি নরকতুল্য হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রেডক্রসের প্রেসিডেন্ট মিরজানা স্পোলজারিক। এছাড়া ইসরায়েলের ৩৬টি হামলায় শুধু নারী ও শিশু নিহত হয়েছে বলে জাতিসংঘের বিশ্লেষণ। এদিকে গাজা জুড়ে ইসরায়েলি বর্বরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদ করা সেনাদের বরখাস্তের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল।
শুক্রবার জেনেভায় রেডক্রসের প্রধান কার্যালয়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রেডক্রসের প্রেসিডেন্ট মিরজানা স্পোলজারিক বলেন, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে হাসপাতালগুলোতে রসদ শেষ হয়ে যাবে। গাজার অনেক স্থানেই খাবার, পানি ও বিদ্যুৎ পাচ্ছে না মানুষ। এখনকার অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করলেই কেবল পরিষ্কার ছবি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। ইসরায়েলের অবরোধে হাসপাতালের রসদ ফুরিয়ে আসছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ছয় সপ্তাহ ধরে কোনো সহায়তা আসেনি। সপ্তাহ দুয়েক পর সব শেষ হয়ে গেলে কাজ চালানোর মতো আমাদের হাতে কিছু থাকবে না। চলমান পরিস্থিতি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর সাম্প্রতিক ঘটনাও বিবেচনায় নিয়েছে রেডক্রস। তিনি বলেছেন, এটা সত্য যে, গাজাবাসীর চলাফেরা বা জীবনধারণ যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করাও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। গত ২ মার্চ গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। এরপর থেকেই রসদ সংকট শুরু হয়। এরপর ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতির শর্ত অগ্রাহ্য করে গাজায় আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, যুদ্ধবিরতির ৪২ দিনে গাজায় ২৫ হাজার ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছিল এবং হামাস এই ত্রাণ ব্যবহার করে তাদের যুদ্ধ-সক্ষমতা পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছে। তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গাজায় অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্লাডব্যাগের সরবরাহ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। জেরুজালেম থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে জেনেভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ডব্লিউএইচও প্রতিনিধি ড. রিক পেপারকর্ন। বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ২২টি সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে।
এদিকে গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ৩৬টি বিমান হামলার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব হামলায় শুধু নারী ও শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
শুক্রবার সংস্থাটি এই যুদ্ধের মানুষের প্রাণহানির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় আরো সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েলের সম্প্রসারিত অবরোধ আদেশ গাজাবাসীদের ক্রমশ সংকুচিত এলাকায় জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করছে। সংস্থার মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি সতর্ক করেছেন, গাজা জুড়ে চলা এই সামরিক হামলাগুলো কোনো নিরাপদ স্থান রাখেনি। তিনি জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, ১৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত গাজায় আবাসিক ভবন ও বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে ইসরায়েলের ২২৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৬টি হামলা সম্পর্কে আমাদের কার্যালয় যাচাই করে তথ্য পেয়েছে, যেখানে এ পর্যন্ত নিহতদের তালিকায় শুধু নারী ও শিশু রয়েছে।
শামদাসানি জানান, গত ৬ এপ্রিল দেইর আল বালাহের আবু ইসা পরিবারের একটি আবাসিক ভবনে হামলায় এক মেয়ে, চার নারী ও চার বছর বয়সি এক ছেলে
নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইসরায়েলের অবরোধ আদেশে ফিলিস্তিনিদের যেসব এলাকায় যেতে বলা হচ্ছে, সেখানেও হামলা চলছে। খান ইউনিসের আল মাওয়াসি এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সেখানে হামলা অব্যাহত রয়েছে। ১৮ মার্চ থেকে এ ধরনের অন্তত ২৩টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। গাজার সর্বদক্ষিণের গভর্নরেট রাফাহতে ৩১ মার্চ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি ব্যাপক স্থল অভিযানের আদেশ জারি করে। ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের সেনারা গাজায় বড় অঞ্চল দখল করছে এবং সেগুলোকে বাফার জোন হিসেবে ঘোষণা করছে, যেখান থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাজ বুধবার বলেন, বড় অঞ্চল দখল করে সেগুলোকে নিরাপত্তা অঞ্চলে পরিণত করা হচ্ছে, যার ফলে গাজা আরো ছোট ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শামদাসানি বলেন, আমাদের কার্যালয়ে রেকর্ড করা তথ্য অনুসারে, সামগ্রিকভাবে নিহতদের মধ্যে বড় একটি অংশই শিশু ও নারী।
এদিকে গাজায় ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলা অব্যাহত রয়েছে। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে নির্বিচারে চালানো হামলায় বাদ যাচ্ছে না আবাসিক ভবন ও আশ্রয় ক্যাম্পগুলোও। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ বেসামরিক ফিলিস্তিনিরা। বিশেষ করে নারী ও শিশু। ফলে লাফিয়ে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। সবশেষ খবরে জানা গেছে, ইসরায়েলি বাহিনী খান ইউনিসের একটি বাড়িতে বোমা হামলা চালিয়েছে। এতে হতাহতের আশঙ্কা করা হচ্ছে ও সেখানে অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। তবে বিধ্বস্ত রাস্তা ও ধ্বংসস্তূপের কারণে অ্যাম্বুলেন্স সেই বাড়িতে পৌঁছানো খুব কঠিন। নুসাইরাতেও একটি ইসরায়েলি কোয়াডকপ্টার একজন ফিলিস্তিনিকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তাছাড়া রাতভর গাজা শহরের শুজাইয়ায় একটি বাড়িতে বোমা হামলা হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গাজা উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে রাফাহ ও খান ইউনিসে ক্রমাগত গোলাবর্ষণ চলছে। ফিলিস্তিনিরা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে। এসব এলাকায় চালানো বর্বর হামলায় হতাহতের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
অন্যদিকে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের সমালোচনা করে প্রকাশিত একটি খোলাচিঠিতে সই করা দেশটির বিমানবাহিনীর রিজার্ভ (অনিয়মিত বা খণ্ডকালীন সেনা) সেনাদের মধ্যে কর্তব্যরত সবাইকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। স্থানীয় সময় শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এক কর্মকর্তা। সংবাদ সংস্থা এপিতে পাঠানো এক বিবৃতিতে আইডিএফের এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ সদস্যদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে দায়িত্বে থাকা সেনাসহ অন্য কারোরই অধিকার নেই সামরিক মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া। যুদ্ধে সক্রিয় থাকা অবস্থায় খোলা চিঠিতে সই করে সেনারা তাদের বাহিনীর কমান্ডার ও অধীনদের মধ্যকার শৃঙ্খলা ও আস্থা ভঙ্গ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন ঐ কর্মকর্তা। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বর্তমানে যুদ্ধে কর্তব্যরত রয়েছেন এমন যেসব সদস্য ঐ খোলাচিঠিতে সই করেছেন, তাদের বরখাস্ত করা হবে। তবে ঠিক কতজন সদস্যকে বরখাস্ত করা হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি।