জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
‘তুই এর আগে প্রশংসাপত্র নিয়ে গেছিস। সেটার টাকা এখনো দিসনি। স্কুল কোনো মাছের বাজার নয়। টাকাগুলো এক্ষুণি পরিশোধ করতে হবে। খালি হাতে সনদ ও নম্বরপত্র আর দেওয়া যাবে না।’গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নওগাঁ সদর উপজেলার ভীমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে হতদরিদ্র পরিবারের এক শিক্ষার্থীকে উদ্দেশ্য করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক হারুন অর রশিদ। শুধু তাই নয়, ওই শিক্ষার্থী ও তার বাবার মান-সম্মান নেই বলেও কটুক্তি করেছেন শিক্ষক হারুন অর রশিদ।পরে এ ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর বাবা।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর নাম মারুফা আক্তার রিনা। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ভীমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে অংশগ্রহণ করে জিপিএ ৪.৬১ পেয়ে সে উত্তীর্ণ হয়। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বর্তমানে বগুড়ার একটি সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মারুফা আক্তার রিনা বলেন, ‘ওইদিন স্কুলে সনদ ও নম্বরপত্র নিতে গেলে স্যাররা রশিদ বহির্ভূত ১ হাজার ১০০ টাকা দাবি করেন। এই ঘুষের টাকা দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমার কৃষক বাবার নেই। তাই টাকা ছাড়া আমার সনদ ও নম্বরপত্র দিতে অনুরোধ করেছিলাম। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে আমার বাবা ঘুষের এই টাকা জোগাড় করে পরিশোধ করতেও চেয়েছে। এক পর্যায়ে আমার মায়ের সামনে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক হারুন।পরে প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষক হারুন স্যারকে বলেন, ওদের কোনো মান সম্মান নেই। তুমি সার্টিফিটেক দিয়ে দাও।
স্কুলটিতে সনদ ও নম্বরপত্র বাবদ জোরপূর্বক ঘুষের টাকা আদায়ের চেষ্টা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুধুমাত্র মারুফার ক্ষেত্রেই হয়নি। এখন পর্যন্ত ওই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যত শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের থেকেই এভাবেই জোরপূর্বক ঘুষের টাকা আদায় করেন শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে প্রশংসাপত্র বাবদ ৬০০ টাকা এবং সনদ ও নম্বরপত্র বাবদ ৫০০ টাকা ঘুষ নির্ধারণ করেছে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পাস করার পর প্রশংসা, সনদ ও নম্বরপত্র স্কুলে আটকে রাখেন শিক্ষকরা। এরপর শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এসব নিতে গেলে ঘুষ চাওয়া হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। এই টাকা না দিলে শিক্ষকরা হুমকি-ধামকিসহ অকথ্য ভাষায় শিক্ষার্থীদের গালিগালাজ করেন। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় অনেক সহজ-সরল অভিভাবককে লাঞ্ছিত করা হয়। এসবের প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো তাদের অপমান করেন শিক্ষকেরা মিলে। এ কারণে অপমানজনক পরিস্থিতির শিকার হয়েও নীরবেই থাকতে হয় অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের।
বিদ্যালয়টিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে এসএসসি পাশ করা আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুন আক্তার নিশি বলেন, দুই সপ্তাহ আগে স্কুলে প্রশংসাপত্র, নম্বরপত্র এবং সনদপত্র নিতে গেলে ১ হাজার ১০০ টাকা দাবি করা হয়। ওই মুহূর্তে এতো টাকা কাছে না থাকায় ৬০০ টাকা দিয়ে শুধুমাত্র প্রশংসাপত্র পেয়েছি। এই টাকার রশিদ চাইলে দেবে না বলে জানান। এই কারণে আমি এখনো কোনো নম্বরপত্র ও সনদ তুলিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সহকারী শিক্ষক হারুন অর রশিদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে সামনাসামনি গিয়ে কথা বলতে হবে জানিয়ে কল কেটে দেন তিনি।ভীমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অহিদুল ইসলাম বলেন, সনদপত্র ও নম্বরপত্র বাবদ কোনো শিক্ষার্থীর থেকে টাকা নেওয়া হয় না। প্রশংসাপত্র কেউ নিতে এলে এলআর ফান্ডে রশিদ ছাড়া পাঁচশ টাকা নেওয়া হয়। এটা নেওয়া সম্পূর্ণ বৈধ বলেই জানি।
তিনি বলেন, মারুফা আক্তার রিনা নামে ওই শিক্ষার্থীকে ওই দিন টাকা ছাড়াই সনদপত্র দিতে বলেছিলাম শিক্ষক হারুন অর রশিদকে। এরপর সেখানে ঠিক কি হয়েছে আমার জানা নেই। যদি কোনো শিক্ষক ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকেন বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শরমিন ফেরদৌসের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।