
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
নকল কারখানায় প্যাকেজিং শেষে বাজারে ছাড়া হচ্ছে ‘রূপচাঁদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল হিসেবে। ইফতারের সুস্বাদু বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রং ও অননুমোদিত কেমিক্যাল ব্যবহার হচ্ছে দেদার। নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে কুলফি, মালাই, চকবারসহ নানা ধরনের আইসক্রিম। থেমে নেই মসলার কারবারিরাও। ভেজাল, ক্ষতিকর ও নিম্নমানের পণ্যে বিভিন্ন মসলা তৈরি করে তা বিক্রি করা হচ্ছে নামি কোম্পানির প্যাকেটে ভরে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে সেমাই। চট্টগ্রামের ঈদবাজার নকলে সয়লাব। রমজানের বাড়তি চাহিদাকে লক্ষ্য বানিয়ে বেপরোয়া অসাধু ব্যবসায়ীরা। খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালালেই মিলছে ভেজালসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ।
কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই পরিচিত ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এতে যেমন ক্রেতারা ঠকছেন, তেমনি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, অভিযান পরিচালনা করা প্রায় ৮০ ভাগ দোকানেই ভেজাল পণ্যসহ নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ে দিশেহারা প্রশাসন। ভেজাল কারবারিতে জড়িতদের ‘গণদুশমন’ আখ্যা দিয়েছেন ক্যাবসহ সচেতন নাগরিকরা।
চট্টগ্রামে নামি প্রতিষ্ঠান পিংকু আইসবার। রমজানের চাহিদা বৃদ্ধি ও ভোক্তার বিশ্বাসকে পুঁজি করে তারা ইচ্ছামতো ভেজাল সামগ্রী দিয়ে তৈরি করছে আইসক্রিম। অনুমোদন ছাড়াই নোংরা পরিবেশে কুলফি, মালাই, চকবারসহ বিভিন্ন আইসক্রিমে ব্যবহার করছে ক্ষতিকর রং। নগরের কর্নেলহাটের মেসার্স খাজা বাণিজ্য সংস্থাও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ভেজাল ও ক্ষতিকর
উপকরণ দিয়ে নিম্নমানের মরিচ, মসলা তৈরি করে তা দামি বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করছে।
নিয়মের তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামের দেওদিঘী বাজারের পূর্ব পাশে একটি বাসায় তেল নকলের কারখানা গড়েছেন মো. ইউনুস। নকল সয়াবিন তেল এনে তা কারখানায় প্যাকেজিং করেন তিনি। খোলাবাজার থেকে বোতল কিনে তাতে মোড়ক লাগানো হচ্ছে আসল রূপচাঁদা ও পুষ্টি ব্র্যান্ডের। একটু খেয়াল করলেই ধরা পড়বে বোতলের মোড়কে নেই বিএসটিআইর কোনো সিল।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাসাটিতে অভিযান চালান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় ৩ হাজার ৫০০ লিটার খোলা ও বোতলজাত তেল, ৬ হাজার ৮০০ পিস এক এবং দুই লিটার পরিমাপের খালি বোতল, নোংরা তেলের ড্রাম ও মোটর জব্দ করা হয়। পরে কারখানা সিলগালা ও মালিক ইউনুসকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জানা যায়, ইউনুসের নকল কারবারিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মো. ইসহাক ও নাসির উদ্দীন।
চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী বাজারের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ইকরাই স্টোর নিজেদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন খাবার তৈরিতে ব্যবহার করছে অনুনমোদিত কেমিক্যাল, রংসহ ক্ষতিকারক নানা উপাদান।
নগরের কালুরঘাট এলাকার সাকসেস অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড তাদের কারখানায় প্রতি লিটার বোতল দেখিয়ে ৯০০ মিলি গ্রামের বোতলে সয়াবিন তেলের পরিবর্তে মাত্র ৮০০ মিলি গ্রাম পাম অয়েল ভরে বিক্রি করছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি বোতলের মোড়কে লাগাচ্ছে ফর্টিফায়েড সয়াবিন তেলের লেবেল। প্রতিষ্ঠানটি মেয়াদোত্তীর্ণ ভিটামিন এ ছাড়াও কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। এসব অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি সাকসেস অয়েলকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি সিলগালা করা হয় তেল নকলে তাদের কারখানা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘রমজানকে লক্ষ্য করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যে কারণে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাতে গিয়ে ভেজাল উপাদান দিয়ে খাদ্যপণ্য তৈরি, ক্ষতিকারক রং, কেমিক্যাল ব্যবহারের মতো অহরহ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার প্রমাণ পাচ্ছি। কেবল বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতেই নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যপণ্য তৈরি করতে পিছপা হচ্ছে না তারা। নামকরা ও বিশ্বস্ত কিছু প্রতিষ্ঠানও অনিয়মে জড়িত, বিষয়টি উদ্বেগের। ভেজাল কারবারিতে জড়িত অন্যদেরও শনাক্ত করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ অব্যাহত আছে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা বলেন, ‘মেসার্স খাজা বাণিজ্য সংস্থা নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খোলা মানহীন মরিচ, মসলা বিভিন্ন কোম্পানির নামে প্যাকেট করে
বাজারজাত করছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি ভোক্তাকে ঠকিয়ে আদায় করছে বাড়তি মুনাফা।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারিস্তা করিম বলেন, ‘ভোজ্যতেলের সংকটকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নকল ভোজ্যতেলের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা নকল ভোজ্যতেল নামকরা ব্র্যান্ডের মোড়কে বোতলজাত করছে। প্রমাণ পাওয়ায় একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়েছে।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রং দিয়ে আইসক্রিম তৈরি ও তা বিক্রি করছে পিংকু আইসবার। প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় গিয়ে পিলে চমকানোর মতো তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। কারখানার মালিক উত্তম চৌধুরীকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’
ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘রমজান আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিতৃপ্তি অর্জনের মাস। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশে মাসটিতে বেশির ভাগ জিনিসের দাম কমানো হয়। অথচ এখানে রমজান এলে বেপরোয়া হয়ে ওঠে অসাধু ব্যবসায়ীরা। শুধু বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিতে খাদ্যে ভেজাল করার মতো গুরুতর অপরাধ করতেও পিছপা হয় না তারা। অথচ মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্য। ভেজাল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অসৎ, অসাধু ব্যবসায়ীদের কেবল জেল-জরিমানা নয়, এর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা এখন সময়ের দাবি।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ‘মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা প্রাণঘাতী রোগের মূল কারণ ভেজাল খাদ্য। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহে বাসা বাঁধে বিভিন্ন অনিরাময়যোগ্য রোগ। এসব জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ভেজাল খাবারের কারণে নষ্ট হয়ে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। বিঘ্নিত হয় মানসিক স্বাস্থ্যও। তাই ভেজাল খাদ্য রোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।’