খুলনা প্রতিনিধি:
খুলনা অঞ্চল থেকে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রপ্তানিতে ক্রমাগত ধস নেমেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৬৭৭ কোটি টাকা। এর ফলে বিপাকে পড়েছেন মাছ রপ্তানিকারকরা। চিংড়ি চাষ কমে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও মূল্য কমে যাওয়ায় খুলনা অঞ্চল থেকে কমেছে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রপ্তানির পরিমাণ। সেই সঙ্গে কমেছে রপ্তানি আয়।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রপ্তানি হয় ৩৩ হাজার ২৭১ টন, যা থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় ২ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে মাছ রপ্তানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৩১৬ টনে, যা থেকে আয় হয় ২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। তবে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ আরও কমে হয়েছে ২৫ হাজার ১৯৬ টনে, যা থেকে আয় হয় ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে মাছ রপ্তানির পরিমাণ কমেছে ৩ হাজার ১২০ টন এবং আয় কমেছে ৬৭৭ কোটি টাকা।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় চিংড়ি ঘের কমেনি। তবে খুলনা জেলায় চিংড়ি চাষ কমে গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খুলনায় মিষ্টিপানির গলদা চিংড়ির ঘের ছিল ২০ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে। গত অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খুলনায় লবণপানির বাগদা চিংড়ির ঘের ছিল ৩৬ হাজার ১৫১ হেক্টর জমিতে। গত অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের কমেছে ৪ হাজার ৭৮৬ হেক্টর জমিতে।
চিংড়িচাষি কয়রা উপজেলার মাটিয়াভাঙ্গা গ্রামের মঞ্জুর আলম ও চরামুখা গ্রামের আলমগীর হোসেন বলেন, আগে তারা বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে তার নিচে পাইপ বসিয়ে চিংড়ি ঘেরে লবণপানি তুলতেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন আর বাঁধ ছিদ্র করতে না দেওয়ায় ঘেরে লবণ পানি তোলা যাচ্ছে না। সে কারণে তারা চিংড়ি চাষ করতে পারছেন না।
বটিয়াঘাটার চিংড়িচাষি রমেন রায় ও আলমগীর হোসেন বলেন, উপজেলার বেশ কয়েকটি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় তারা লবণপানি না পাওয়ায় চিংড়ি চাষ করতে পারছেন না। তারা জানান, অনেকে স্বেচ্ছায় চিংড়ি চাষ ছেড়ে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষ করছে। পুঁজি সংকট, ভাইরাস ও দাপদাহে চিংড়ির মড়কের কারণে অনেকে চিংড়ি চাষ ছেড়ে দিয়েছে। এ ছাড়া চিংড়ি ঘেরের বেশ কিছু জমিতে ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, চিংড়ি চাষ কমে যাওয়ায় গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টন চিংড়ি কম উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা এবং মূল্য কমে গেছে। বিশেষ করে ছোট সাইজের চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে যে মূল্য আছে, স্থানীয় বাজারে মূল্য তার চেয়ে বেশি। সে কারণে চাষিরা রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি না করে ছোট সাইজের চিংড়ি স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন।
মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তর খুলনার মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার জানান, খুলনা অঞ্চল থেকে চিংড়ি ছাড়াও ইলিশ, ভেটকি, পাবদা, টেংরা ও পারশে মাছ রপ্তানি হয়। যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে কয়েকটি দেশে চিংড়ির চাহিদা ও মূল্য কমেছে। সে কারণে রপ্তানির পরিমাণ কমার পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও কমে গেছে।
তিনি জানান, খুলনা অঞ্চলে রপ্তানিকারক ৪১টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু নিয়মিত রপ্তানি করছে মাত্র ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান।
রপ্তানির পরিমাণ ও আয় কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চিংড়ি রপ্তানিকারকরা। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, খুলনার হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী গলদা ও বাগদা চিংড়ি পাচ্ছে না। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় একই রকম রয়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক হুমায়ুন কবীর বলেন, চিংড়ি রপ্তানিকারক কারখানাগুলো এখন চাহিদার ৪ ভাগের ১ ভাগ মাছ পাচ্ছে। সে কারণে অন্তত ১০-১২টি কারখানা ঠিকমতো চিংড়ি রপ্তানি করতে পারছে না। এর ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। তিনি জানান, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেক দেশ এখন বাগদা ও গলদা চিংড়ির পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের ভেনামি চিংড়ি কেনে। বাংলাদেশ থেকে বেশি বিদেশে যায় গলদা ও বাগদা চিংড়ি। দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ হয় খুব সীমিত পরিসরে।