প্রভাষ আমিন
কোনোভাবে শিক্ষার্থী মারা গেলেই আমরা লিখি ‘মেধাবী শিক্ষার্থী’। সব শিক্ষার্থীরই কিছু না কিছু মেধা আছে। কিন্তু যারা পড়াশোনার ধারাবাহিকতায় প্রবল প্রতিযোগিতা ডিঙিয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, তারা নিশ্চয়ই মেধাবী। পরিবারের সবাই যখন হবু ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্নে বিভোর, তখনই সড়ক কেড়ে নিলো সব স্বপ্ন।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নে চুয়েট ক্যাম্পাস অবস্থিত। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের একটি অংশ পড়েছে চুয়েট ক্যাম্পাসে। ২২ এপ্রিল ২০২৪ বিকেলে চুয়েটের তিন শিক্ষার্থী মোটরসাইকেলে করে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। উল্টোদিক থেকে আসা শাহ আমানত পরিবহনের একটি বাস ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শান্ত সাহা, হাসপাতালে নিয়েও বাঁচানো যায়নি একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিক হোসাইনকে। এই ঘটনায় গুরুতর আহত পুরকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাকারিয়া হিমু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কারও মৃত্যুর পর জানাজায় স্বজনরা নানা কথা বলেন। মৃতের হয়ে ক্ষমা চান। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বোঝা হলো পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। তৌফিক হোসাইনের লাশের বোঝায় বিধ্বস্ত পিতা দেলোয়ার হোসেন জানাজার সময় বললেন, ‘এই ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা সব কেড়ে নিলো।’
শিউলি রাণী বলেন, “পোলা ইঞ্জিনিয়ার হইয়া বিদেশে যাইব। আমারে কইছিল, ‘মাগো তোমারে বিদেশে নিয়া গিয়া চিকিৎসা করামু।’ এখন আমারে বিদেন নিয়ে যাইবো কেডা।” শুধু তৌফিক হোসাইন বা শান্ত সাহা নয়; প্রতিদিন এমন অসংখ্য স্বপ্ন সড়কে বিলীন হয়ে যায়। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন লম্বা হয়।
বাংলাদেশে কোনোকিছুরই ধারাবাহিকতা নেই, সড়ক দুর্ঘটনা ছাড়া। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর থাকে। আমরাও দুর্ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলে প্রথম পাতায় আসে, নইলে ভেতরের পাতায়। তারপর আমরা ভুলে যাই। কিন্তু যারা মারা যান, তাদের স্বজনরা এই ব্যথা কখনোই ভুলতে পারেন না। যারা আহত হন তাদেরও সেই ক্ষত বয়ে বেরাতে হয় সারাজীবন। নিটোল-নিলয় গ্রুপের একটি স্লোগান আছে—একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। এরচেয়ে সঠিক স্লোগান আর হতে পারে না। আসলেই দুর্ঘটনার কান্না কখনো থামে না।
দুর্ঘটনায় শান্ত ও তৌফিকের মৃত্যুর পর থেকে চুয়েট শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় আন্দোলন করছে। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা দাবি জানাচ্ছে। মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চাইছে। আন্দোলন চলছে। জানি আন্দোলন থেমেও যাবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ২ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ চাইছে। মালিক সমিতি দিতে চাইছে ২ লাখ টাকা। টাকার অঙ্ক যাই হোক, শান্ত-তৌফিকের পরিবারের কাছে কোনো অঙ্কই যথেষ্ট নয়। সন্তান হারানোর ক্ষতির কোনো পূরণ হয় না। টাকা কখনো সন্তান হারানোর বেদনা প্রশমিত করতে পারে না।
আমরা সবাই লিখি বটে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। সড়কে দুর্ঘটনা হতেই পারে, সব দেশেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সব দুর্ঘটনাকে আমার কাছে দুর্ঘটনা মনে হয় না। নিশ্চিতভাবে অনেকগুলো খামখেয়ালির ফল। কখনো গাড়ির দোষে, কখনো চালকের খামখেয়ালিতে, কখনো রাস্তার দোষে দুর্ঘটনা ঘটে।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক শামসুল হক একটি পত্রিকায় লিখেছেন, ‘শুধু সড়ক নয়; গাড়ি-চালককেও ফিট হতে হবে।’ আসলেই কয়েকবছরে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। সারাদেশ এখন এক নিরবচ্ছিন্ন সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায়। কিন্তু শুধু রাস্তা ফিট হলেই হবে না।
গাড়ি এবং চালককেও ফিট হতে হবে। শাহ আমানত পরিবহনের যে গাড়িটির ধাক্কায় শান্ত-তৌফিকের প্রাণ গেছে, তা ১৯৮০ সালে কেনা। মানে ৪৪ বছরের পুরোনো বাসটি রাস্তায় চলছিল ফিটনেস ছাড়াই। ভাঙাচোরা গাড়িটি কিনে কিছু মেরামত কাজ করিয়ে শাহ আমানত পরিবহন নামে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে নামিয়ে দেওয়া হয়। ফিটনেস বা কর সনদ ছাড়াই মৃত্যুদূত হয়ে সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল বাসটি। বাসের ফিটনেস নেই, এবার আসি চালকের ফিটনেস প্রসঙ্গে।
ঘটনার তিনদিন পর ঘাতক চালক তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন জানা যাচ্ছে, চালকের লাইসেন্সেরও মেয়াদ ছিল না। ৪৪ বছরের পুরোনো ফিটনেসবিহীন বাস, চালাচ্ছেন মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সওয়ালা চালক। তারপরও একে দুর্ঘটনা বললে অন্যায় হবে। এটি একটি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশে অনেক অদক্ষ চালক স্টিয়ারিঙে বসে যান। কিছুদিন চালকের কাছে শিখে হেল্পাররাই চালক বনে যান। লাইসেন্স পেতেও সমস্যা হয় না। তাদের নেতা শাজাহান খান তো আগেই বলে রেখেছেন, গরু-ছাগল চিনলেই যেন লাইসেন্স দেওয়া হয়।
ফিটনেসবিহীন বাস, লাইসেন্সবিহীন চালক কীভাবে রাস্তায় নামে। গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিআরটিএর হিসাবে, চট্টগ্রাম শহর ও জেলায় চলাচলকারী মোট নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে ৭০ হাজারের বেশি ফিটনেসবিহীন। অনিবন্ধিত বা ফিটনেসবিহীন এসব গাড়িই রাস্তায় চলছে দেদারসে। আর অবাধে চলছে বলেই, দুর্ঘটনা বাড়ছেই।
রাস্তা এত ভালো হওয়ার পরও মৃত্যু কমেনি। ঈদের ছুটির ১৫ দিনে সারা দেশে ৩৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের দেশে যেহেতু মানুষ বেশি তাই একেক দুর্ঘটনায় ৮ জন, ১০ জন, ১২ জন, ১৪ জন করে মারা যাচ্ছেন। কিন্তু কারও কোনো বিকার নেই।
বাংলাদেশে পদে পদে অনিয়ম। বিআরটিএ তো পুরো অনিয়মের আখড়া। কিন্তু যেখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন সেইখানেই অনিয়মের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি থাকতে হবে। ফিটনেসের ব্যাপারে বা চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় চলবে না। চালকরা যাতে গাড়ি চালানোর ফাঁকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
বিআরটিএ বলছে, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি রাস্তায় চললে তাদের কিছু করার নেই, তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। দায়িত্ব যারই হোক, তাকে সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। করতে হবে, আমরা সবাই জানি। কিন্তু কেউ করছি না। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও কয়েকদিন আগে বলেছেন, লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে আমাদের শান্ত-তৌফিকের মতো শত-হাজার স্বপ্নের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঘাতক চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বটে। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তার কিছুই হবে না। কিছুদিন হয়তো জেলে থাকবে। তারপর আবার বেরিয়ে আবার মানুষ মারবে। প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। এবার শুধু চুয়েটে আন্দোলন হচ্ছে। অনেক দুর্ঘটনার পর সারাদেশে আন্দোলন হয়েছে।
আন্দোলনের চাপে অনেক প্রতিশ্রুতি হয়েছে, আইন হয়েছে। কিন্তু কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। আইন হলেও প্রয়োগ হয়নি। বরং চালকদের চাপে আইন বদলে গেছে। বাংলাদেশে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সুসংগঠিত মাফিয়া। চাইলে তারা দেশ অচল করে দিতে পারে। তাই তারা চাপ দিয়ে যেকোনো দাবি আদায় করতে পারে। শাস্তি যদি না হয়, তাহলে দুর্ঘটনায় ঘটতেই থাকবে।
সব দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে মানুষ মারার সবচেয়ে নিরাপদ উপায় সড়ক। আপনি গুলি করে বা পিটিয়ে কাউকে হত্যা করলে আপনার ফাঁসি হবে। কিন্তু আপনি যদি গাড়ি চাপা দিয়ে মারেন, আপনার কিছুই হবে না।