চোরের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাবুগঞ্জ

প্রকাশিত: ১২:৫৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২৪

জেলা প্রতিনিধি বরিশাল

প্রতিনিয়ত চোরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দারা। প্রতি রাতেই উপজেলার কোথাও না কোথাও ঘরে, দোকানে গরুসহ বিভিন্ন চুরির ঘটনা ঘটছে। লাগামহীন চুরির ঘটনায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। থানায় অভিযোগ করেও মিলছে না কোনো প্রতিকার। চোরের উৎপাতে অতিষ্ঠ খোদ প্রশাসনও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি ডরমিটরি ভবন থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর মোটরসাইকেল উধাও, উপজেলা অডিটোরিয়াম থেকে খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৭টি ফ্যান, উপজেলা পরিষদ চত্বরের মধ্যেই নেই চারটি টিউবওয়েলের মাথা, এমনকি গ্রিল খুলে নেওয়া হয়েছে ইউএনওর বাসভবন থেকে। সর্বশেষ সোমবার (২২ জানুয়ারি) রাতে উপজেলা কোর্ট বিল্ডিং থেকে খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লোহার গ্রিল। প্রশাসনের নাকের ডগায় খোদ উপজেলা পরিষদ চত্বরে গত চার মাসে ১৮টি চুরির ঘটনা ঘটলেও একটি ঘটনায়ও চোর শনাক্ত কিংবা মালপত্র উদ্ধার হয়নি।

অপ্রতিরোধ্য এসব চুরির ঘটনায় মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) বাবুগঞ্জ উপজেলার আইনশৃঙ্খলা ও সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও। প্রায় এক ঘণ্টার ওই সভার পুরোটা সময় ছিল চুরি সংক্রান্ত আলোচনা। এ সময় বিভিন্ন বক্তা লাগাতার এসব চুরির ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য দেন।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল করিম হাওলাদার জানান, তার চাঁদপাশা এলাকার চিহ্নিত চোর-বাটপার আর মাদকসেবীদের সঙ্গেই পুলিশের দহরম-মহরম সম্পর্ক। টহল কিংবা চুরির তদন্তে এসে চোরের সঙ্গেই চা খায় পুলিশ। ফলে প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।

ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল আহসান হিমু, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন রাঢ়ীসহ সভায় উপস্থিত সাংবাদিকরা অভিযোগ করে বলেন, চুরির ঘটনা নিয়ে কেউ থানায় গেলে তাকে নাম ধরে মামলা করতে বলে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট নাম ছাড়া মামলা নিতে চায় না। শুধু একটা জিডি নম্বর দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে তারা। চুরির ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় চোরের নামে থানায় অসংখ্য মামলা থাকলেও পুলিশি তদন্তে একটি ঘটনারও কূলকিনারা হয় না। চুরি-ডাকাতির ঘটনায় কাউকে আটক কিংবা মালপত্রও উদ্ধার হয় না। তাই এখন চুরি-ডাকাতির শিকার হলে মানুষ আর থানায় যায় না। এমনকি থানায় জানায়ও না।

সম্প্রতি বাবুগঞ্জ উপজেলা চত্বরের ১০০ গজের মধ্যে লিটন গাজীর একটি অটোরিকশা এবং শাহনাজ বেগমের চায়ের দোকানে চুরি হয়।

লিটন গাজী বলেন, থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ বলে আসামির নামসহ দিতে। রাতের আঁধারে আমার বাড়ি থেকে কে বা কারা আমার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশাটি চুরি করে নিয়ে যায়। আমি কার নামে মামলা দেবো? আমি কি দেখেছি কে চোর? শেষে মামলা না করে শুধু একটা জিডি করে ফিরে এসেছি।

হতদরিদ্র শাহনাজ বেগম বলেন, আমার পরিবারের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন উপজেলা গেটের সামনে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। সেটাতে কিছুদিন আগে চায়ের ফ্লাস্ক, কেতলিসহ দোকানের সবকিছু নিয়ে গিয়ে আমাকে সর্বস্বান্ত করেছে চোররা। পুলিশ এবং প্রশাসনের লোকজন দফায় দফায় এসে দেখে যায়। ওই পর্যন্তই সান্ত্বনা। আর কিছুই হয়নি।

উপজেলার খানপুরা গ্রামের গৃহবধূ মৌসুমী আক্তার বলেন, তার বাড়ির সিঁড়ির নিচ থেকে কলাপসিবল গেট ভেঙে পানির মোটর চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক টিউবওয়েলের মাথা এবং অর্ধশতাধিক গরু চুরি হলেও কোনো ঘটনায় চোর আটক কিংবা মালপত্র উদ্ধার হয়নি। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং চুরি মামলার তদন্তে গাফিলতি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বাবুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মাকসুদ আলম বলেন, চুরির ঘটনায় আমরা অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা নিই না, কিংবা চুরি মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই বিষয়টি এমন নয়। আমাদের ৪০-৪৫ জন সদস্য দিয়ে কী বাবুগঞ্জের দেড় লাখ মানুষের বাড়িতে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? আমাদের নৈশ টহল টিমের দায়িত্ব থাকে মূলত প্রধান সড়ক এবং এর আশপাশের এলাকা। গ্রামের মধ্যে চুরি হলে সেক্ষেত্রে আমাদের তাৎক্ষণিক কিছু করার থাকে না। তবে চুরি প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয়ভাবে পাহারার ব্যবস্থা করা জরুরি।

এ ব্যাপারে বাবুগঞ্জের ইউএনও শাকিলা রহমান বলেন, দিনের পর দিন এভাবে চুরির ঘটনা ঘটতেই থাকবে আর চোর শনাক্ত হবে না, চুরি যাওয়া মালপত্র উদ্ধার হবে না, মামলা হলে কোনো সুরাহা হবে না, এটা চলতে পারে না। এটা মগের মুল্লুক নয়। সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। প্রত্যেক অফিস যাদের নৈশপ্রহরী আছে এবং নৈশ টহল পুলিশ প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

বাবুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী ইমদাদুল হক দুলাল বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর বাবুগঞ্জ উপজেলা চত্বরের ভেতরে এবং এর আশপাশে যত চুরির ঘটনা ঘটেছে গত পাঁচ বছরে, এর একটি ঘটনারও কোনো ফয়সালা হতে দেখিনি। মামলা হলেও সেগুলো হিমাগারে চলে যায়। একটি মামলারও আসামি গ্রেফতার কিংবা লুণ্ঠিত মালপত্র উদ্ধার হতে দেখিনি। এটি প্রশাসনের জন্য লজ্জার। পুলিশের কাছ থেকে মানুষ পেশাদার আচরণ আশা করে।