চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফিরছে ৮ বছর পর পাকিস্তানের অপেক্ষার ইতি, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও বিশ্বকাপ কেন আলাদা

প্রকাশিত: ১২:৪৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫

ক্রীড়া ডেস্ক :

নিরাপত্তাজনিত কারণে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ ছিল। আর সর্বশেষ বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট হয়েছিল ১৯৯৯৬ সালে। ২০১৮ সাল থেকে দেশটিতে বিভিন্ন দেশ ক্রিকেটীয় সফর শুরু করলেও ব্যতিক্রম ছিল কেবল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। এবারও তারা হেরফের করেনি। ধারাবাহিকতা ধরে রেখেই পাকিস্তান থেকে টুর্নামেন্ট সরিয়ে নিতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। সে দফায় সফল না হলেও, ভাগ বসিয়েছে পাকিস্তানের আয়োজক সত্ত্বে। ফলে নিজেদের ম্যাচগুলো সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে নিরপেক্ষ ভেন্যু দুবাইতে। পাকিস্তানে দীর্ঘ সময় আইসিসি ইভেন্ট হয়নি সত্যি, তবে এ সময় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বন্ধ থাকেনি। ছেলেদের ক্রিকেটে ২৫ এবং মেয়েদের ক্রিকেট ১৬টি আইসিসি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থনৈতিক, পর্যটন ও ক্রিকেটীয় উন্নতিসহ কত খাতে পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা বলাই বাহুল্য!

দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট এখন অনেক বড় আবেগের নাম, যদিও ভারতে সেটি বৃহৎ বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা করার কথা ছিল পাকিস্তানেরও। কিন্তু দেশটির উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বেরসিক হস্তক্ষেপ ক্রিকেট তো বন্ধ করেছেই, পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ক্রিকেটের বাজার সম্প্রসারণে। পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে ২০০১ সালে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কয়েক বছর উভয়পক্ষের এই যুদ্ধ সামরিক-বেসামরিক ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তানের নিরাপত্তায়ও বিঘ্ন ঘটায়।

সেটি উৎরে গিয়ে পাকিস্তান বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এরই মাঝে ২০০৯ সালে ঘটে যায় দেশটির ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক ঘটনা। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট দল পাকিস্তান সফরে গেলে লাহোরে তাদের টিমবাসে হামলা চালায় বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা। যেখানে অন্তত ৬ লঙ্কান ক্রিকেটারও আহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া পাকিস্তান পুলিশের ৬ সদস্য ও দুজন সাধারণ নাগরিক নিহত হন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল। ফলে মাঝপথেই পাকিস্তানে সফর সমাপ্ত করতে বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা। হামলার দিন দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা ছিল। এরপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের মাটিতে সফরে যায়নি অন্য কোনো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ।

২০১৮ সালেই নাটকীয়ভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটার পর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তন হয়। এরপর থেকে একে একে সকল দেশই সেই ভূমিতে সিরিজ খেলতে যেতে থাকে। ব্যতিক্রম কেবল ভারত। এর পেছনে রয়েছে দেশ দুটির দীর্ঘ রাজনৈতিক টানাপোড়েন। তাতে জ্বালানি দিয়েছে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা ভারতের বৃহত্তম শহরটিতে চারদিনব্যাপী ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ১৬০-১৭৫ জনকে হত্যা করে। এরপর কূটনীতির পাশাপাশি দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্কের দরজাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই সম্পর্কের গেরো খুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পিসিবি।

যার প্রমাণ মেলে পিসিবির সাবেক সভাপতি নাজাম শেঠির কথায়। ভারতকে তাদের মাটিতে খেলতে নামানোই বড় সফলতা বলে মনে হয় তার কাছে, ‘ছয় বছর ধরে পাকিস্তানে প্রায় প্রতিটি দল সফর করছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ঘটনাটা তখনই ঘটবে, যখন ভারত-পাকিস্তান এই মাটিতে পরস্পর মুখোমুখি হবে। আমি মনে করি সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ব্রেকথ্রু।’

কেমন থাকছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তান পর্বের ম্যাচগুলো হবে তিনটি ভেন্যুতে। ফলে দেশটির ৩টি শহর করাচি, লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিকে ঢেকে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তার চাদরে। রাজনৈতিক বিরোধ ও নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভারত দেশটিতে সফর করছে না ২০০৮ সালের পর থেকে। শেষ পর্যন্ত এবারও তাদের রাজি করাতে পারেনি পাকিস্তান, তবে একইসঙ্গে অন্য দেশগুলোর নিরাপত্তায়ও আয়োজকরা কোনো ত্রুটি রাখতে চায় না।

লাহোর ও রাওয়ালপিন্ডিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা জানিয়ে পাঞ্জাবের পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) উসমান আনোয়ার বলেছেন, ‘দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়, কর্মকর্তা ও ক্রিকেট-ভক্তদের জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’ শহর দুটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের সংখ্যা জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ ও দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। তথ্যমতে, দুটি শহরে সবমিলিয়ে ১২০০০ অফিসার শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। তাদের মধ্যে আছেন ১৮ জন সিনিয়র কর্মকর্তা, ৫৪ জন ডিসিপি, ১৩৫ ইন্সপেক্টর, ১২০০ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ১০৫৫৬ জন কনস্টেবল এবং ২০০ নারী পুলিশ অফিসার।

রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ৩টি করে ম্যাচ রয়েছে। লাহোরের ম্যাচগুলো হবে যথাক্রমে ২২ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং ৫ মার্চ। এ ছাড়া রাওয়ালপিন্ডিতে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ২৪, ২৫ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি। খেলা চলাকালে এই দুই শহরে খেলোয়াড়দের আবাসস্থল, যাতায়াত পথ ও স্টেডিয়ামের আশপাশে সার্চ, সুইপ, কম্বিং ও গোয়েন্দাভিত্তিক বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাঞ্জাব পুলিশের মহাপরিদর্শক। এ ছাড়া সব জায়গায় আধুনিক ক্যামেরা প্রযুক্তিও নজরদারিতে থাকবে।

অন্যদিকে, রয়টার্সের আরেক প্রতিবেদনে ম্যাচ হতে যাওয়া তিনটি শহরে ২০ হাজার নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত থাকার কথা জানিয়েছেন পাঞ্জাব প্রদেশের ডেপুটি পুলিশ প্রধান শাহজাদা সুলতান। তিনি বলেন, ‘প্রদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যে নিরাপত্তা পান, খেলোয়াড়রাও তেমনই সেবা পাবেন।’ লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি এমনকি ইসলামাবাদেও নিরাপত্তাবাহিনীর ২০ হাজার সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে ভবনের ছাদ থেকে সতর্ক অবস্থায় থাকবেন স্নাইপাররা। খেলোয়াড়দের আবাসস্থল এবং যাতায়াত সর্বত্র সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকবে।

করাচি প্রদেশের মেয়র মুরতাজা ওয়াহাব বলছেন, জরুরি প্রয়োজনে করাচি পুলিশ অতিরিক্ত সোয়াট ইউনিট মোতায়েন রেখেছে। যেকোনো সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় চালু রয়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও তুলনামূলক বেশ ভালো।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও ওয়ানডে বিশ্বকাপ: ওয়ানডেতে কেন দুটি বৈশ্বিক ইভেন্ট
তিন ফরম্যাটেই বিশ্বের সেরা দল নির্বাচনে বিশ্বকাপ আয়োজন করে আসছে আইসিসি। সাদা বলের দুই ফরম্যাটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩টি ওয়ানডে এবং ৯টি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রাচীন এবং অভিজাত সংস্করণ টেস্ট বাকি থাকবে কেন! ২০১৯ সাল থেকে তিন বছরের চক্র শেষে আয়োজিত হয়ে আসছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। চলতি বছরের জুনে বসবে এই প্রতিযোগিতার তৃতীয় সংস্করণের ফাইনাল। গত আসরের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা শিরোপানির্ধারণী ম্যাচটিতে মুখোমুখি হবে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ওয়ানডে বিশ্বকাপ থাকা সত্ত্বেও একই ফরম্যাটে কেন আরেকটি টুর্নামেন্ট চালু করতে হলো। মূলত এর নেপথ্যে ছিল একটি মহৎ উদ্দেশ্য। প্রাথমিকভাবে আইসিসির নন-টেস্ট (সহযোগী দেশ) খেলুড়ে দেশগুলোর ক্রিকেটীয় উন্নয়নে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সাল থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রতিযোগী সংখ্যা ও পরিসর বিস্তৃত হলেও, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তার সংক্ষিপ্ত রূপ! এটি অনেকটা ফিফা কনফেডারেশন্স কাপের মতো। বিশ্বকাপ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন ও ছয়টি মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়নদের অংশগ্রহণে সম্পন্ন হতো (২০১৯ সালের পর বিলুপ্ত) এই টুর্নামেন্টটি।

শুরুতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ছিল ‘উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ বা ‘আইসিসি নকআউট ট্রফি’ নামে। ‘মিনি ওয়ার্ল্ডকাপ’ বলেও পরিচিত ছিল এটি। সহযোগী দেশগুলোর ক্রিকেটে আর্থিক সহায়তা এবং সেসব ভূমিতেও খেলাটিকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। এর প্রথম দুই আসরও মাঠে গড়ায় তৎকালীন দুটি সহযোগী দেশে (বাংলাদেশ ও কেনিয়া)। টুর্নামেন্টটির প্রথম দুই আসর হয়েছিল নক-আউট পদ্ধতিতে। ২০০২ আসরে এর নাম বদলে ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি’ করা হয় এবং ২০০৪ সাল পর্যন্ত আসর বসতে থাকে ২ বছর পরপর। এরপর ২০০৯ সাল থেকে র‍্যাঙ্কিংয়ের ৮টি দল নিয়ে রাউন্ড রবিন লিগ ফর‌ম্যাট মেনে হয়ে আসছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

২০২৫ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য যোগ্য দল নির্বাচিত হয় গত ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে। সেখানে আয়োজক পাকিস্তানসহ পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ আটটি দল এবারের প্রতিযোগিতার জন্য টিকিট নিশ্চিত করে। যেখানে জায়গা হয়নি সাবেক দুই চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের। দুই গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে যাওয়া দেশগুলো হচ্ছে– ‘এ’ : ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ ‘বি’ : অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও আফগানিস্তান। আজ (১৯ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হয়ে টুর্নামেন্টটির নবম আসর চলবে ৯ মার্চ পর্যন্ত।