মোঃ সাইফুল ইসলামঃ
শেষ চৈত্রের গরমে দেশের জনজীবন অতিষ্ঠ। চাহিদামতো বিদ্যুৎ না পেয়ে সেই কষ্ট আরও বেড়েছে। শহরের চেয়ে গ্রামে বিদ্যুতের সরবরাহ অপেক্ষাকৃত কম, লোডশেডিং বেশি। এর মধ্যেই ঈদের ছুটিতে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে গ্রামে যাওয়া মানুষ পড়েছে বাড়তি ভোগান্তিতে। একই সঙ্গে সেচ মৌসুমে লোডশেডিংয়ের কারণে সময়মতো বিদ্যুৎ না পেয়েও বিপাকে পড়েছেন অনেক কৃষক।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত শনিবার দিনে সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২৪ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ১৪ হাজার ৬৪ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, এদিন লোডশেডিং হয় ৯৬০ মেগাওয়াট। গত রবিবার ১৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ হয় ১২ হাজার ৯৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অর্থাৎ, এদিনও চাহিদার চেয়ে ২৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হয়। এ দুই সরকারি ছুটিতে এই লোডশেডিংয়ের তথ্য মূলত সাবস্টেশন পর্যায়ের। অবচয় ক্ষতি ও সিস্টেম লসের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পিডিবির হিসাবমতে, সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে কুমিল্লা অঞ্চলে। এরপর ক্রমান্বয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ কম পাওয়া অঞ্চলগুলো হলো—ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর। সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও বরিশালে লোডশেডিং অপেক্ষাকৃত কম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরে গড়ে সর্বোচ্চ দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং হয়েছে। সামনে এটি ২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তবে গ্রাহকেরা তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলছেন, এলাকাভেদে দৈনিক ৫ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে। রাজধানীতে এলাকাভেদে এক থেকে তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক স্থানে ইফতার, তারাবির নামাজ ও সেহরির সময় বিদ্যুৎ না পেয়ে বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।এবার ঈদের ছুটিতেও লোডশেডিং অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু ঈদযাত্রা নয়, গ্রামে থাকাকালীন শহুরে বা গ্রামীণ—সব শ্রেণির মানুষেরই ভোগান্তি ও বিপত্তি বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় জ্বালানির পর্যাপ্ত সংস্থান না থাকায় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটাই আমদানিনির্ভর। এখন মার্কিন ডলার এবং দেশীয় টাকারও প্রয়োজনীয় পরিমাণ জোগান নেই। তাই এলএনজি (গ্যাস) ও জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বিপুল বিল বকেয়া পড়ে রয়েছে। চিত্রটা এমন দাঁড়িয়েছে, অর্থের অভাবে জ্বালানির সরবরাহে ঘাটতি। তাই বিদ্যুতের উৎপাদন ও বিতরণে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পিডিবি ও পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, গ্যাস-সংকটের কারণে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদনক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস পড়ে রয়েছে। বর্তমানে একটি এলএনজি টার্মিনাল চালু থাকলেও ঈদের আগেই অপর ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি চালু হবে। তখন পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি সরবরাহ করা গেলে ঘাটতি কমবে বলে আশা করছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ।
এদিকে লোডশেডিংয়ে কৃষিসেচে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা জানিয়েছেন। বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকছে গভীর ও অগভীর নলকূপ। মাটি খুঁড়ে শ্যালো মেশিন বসিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম ও তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। সুবিধামতো সেচ দিতে না পারায় খরায় পুড়ছে বহু কৃষকের ইরি-বোরো খেত। রাজশাহী অঞ্চলের অনেক সমতলভূমির সেচযন্ত্রে পানি উঠছে না। এর মধ্যে লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুৎ এলে ভোল্টেজ থাকে খুবই কম, যার ফলে সেচপাম্পগুলো পুড়ে যাচ্ছে।
লোডশেডিংয়ের খণ্ডচিত্র- পিডিবির তথ্যমতে, গত শনিবার রাত ১২টায় লোডশেডিং হয় ১ হাজার ৭৫২ মেগাওয়াট। এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। রাত ১টায় চাহিদা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। সে সময় লোডশেডিং হয়েছে ১ হাজার ৬৩৬ মেগাওয়াট। রাত ২টায় চাহিদা একই থাকলেও উৎপাদন কিছুটা বাড়ায় লোডশেডিং কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৩৭ মেগাওয়াট। রাত ৩টায় চাহিদা আবার বেড়ে হয় ১৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সে সময় লোডশেডিং হয় ১ হাজার ৫৬১ মেগাওয়াট। রাত ৪টায় লোডশেডিং হয় ১ হাজার ৩৩৫ মেগাওয়াট। এরপর কিছুটা ওঠানামা করলেও সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কখনোই ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াটের কম লোডশেডিং হয়নি। এর মধ্যে সকাল ৭টায় সর্বনিম্ন ১ হাজার ১৩০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। আর বেলা ৩টায় তা ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। এরপর আবারও লোডশেডিং কিছুটা কমে।