জনগণের আকাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে

প্রকাশিত: ১২:২৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৭, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি। ব্যবসায়ী নেতার পাশাপাশি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে তিনি দেশের রাজনীতির অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন। ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়েও নানা বিষয় উঠে এসেছে তার কথায় । তিনি বলেছেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ফলে বা আন্দোলনের মুখে সরকার চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষিত বা প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। তার সঙ্গে কথা বলেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাইদুল ইসলাম

ইত্তেফাক: আপনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরলেন ১৯৮১ সালে। এর পরের সময়ের রাজনীতি খুব কাছ থেকে দেখেছেন । এ সময়ের রাজনীতির বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আবদুল আউয়াল মিন্টু: ১৯৮১ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। তার পরপরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহিদ হওয়ার সামান্য কিছু দিন পর দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয় । তার পরও তখনকার সময়ে মানুষের মধ্যে যে স্পৃহা ও উদ্যম দেখেছি, ক্রমান্বয়ে তা কমে এসেছে । যদিও তখন জনসংখ্যা ছিল কম, এখন তা অনেক বেড়েছে। তখন সমাজের লোকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বিদ্যমান ছিল। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, কিন্তু শত্রুতা ছিল না । এখন রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে শত্রুতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে না পারলে সমাজকে উন্নত করা যাবে না । তাই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সহযোগিতার ধারা তৈরি করাটা জরুরি । তবে এটি বলতে পারি যে, আমাদের সমাজে বর্তমানে যে বিশৃঙ্খলা, তা আমি অতীতে কোনো দিন, বিশেষ করে ১৯৯০ সালের আগে দেখিনি। সে সময় মানুষের মধ্যে যে অপরাধপ্রবণতা ছিল না, তা নয়। তবে তা একটি সহনশীল মাত্রায় ছিল ।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য প্রকাশ করে । সবার সম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম নির্বাচনে জনগণের ভোটে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশে-বিদেশে সবার কাছে প্রথম নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মাগুরা উপনির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে । অতঃপর দেশে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যতে দেশে যাতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্থায়ী রূপ দেয় এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। সে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করলেও মিত্রদের সমর্থনে সরকার গঠন করে । এরপর ২০০১ সালে বিএনপি আবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় । মেয়াদ শেষে আওয়ামী লীগ এমন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যার ফলে পরোক্ষভাবে দেশে সেনাশাসন ফেরত আসে, যার জের এখনো জাতি টানছে। নানা টানাপড়েনের পর ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয় তা গ্রহণযোগ্য ছিল না । সে নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর প্রহসন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই পুরো রাষ্ট্রকাঠামো থেকে শুরু করে দেশের সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেগুলো দুর্বল, এমনকি বলা যায় যে, ধ্বংস করে দেয়। এটা করা হয় একমাত্র অবৈধভাবে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার লক্ষ্যে এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ।

ইত্তেফাক: একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে । এ সরকার নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আবদুল আউয়াল মিন্টু: ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ফলে বা আন্দোলনের মুখে সরকার চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশ সরকার ছাড়া চলতে পারে না। ডকট্রিন অব নেসেসিটির আওতায় সরকার গঠিত হয়েছে। তবে শুধু যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে, সেটি বলা যাবে না। সব বিরোধী দল ও গোষ্ঠী একসঙ্গে আন্দোলন করেছে। তাই সরকারকে আপনি জনগণের দ্বারা সমর্থিত সরকার বলতে পারেন। বিগত সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপি এবং তার মিত্ররা গত ১৬ বছর ধরে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য জনগণের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। অত্যাচার, নির্যাতন, লাঞ্ছনা, জুলুম সবই সহ্য করেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৬৫ লাখ লোককে। সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পর আমরা এ সরকারকে সমর্থন দিয়েছি। গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয় । এ সরকারকে আমরা যত সমর্থনই করি না কেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন ছাড়া কোনো সরকারকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। তাই আমাদের সংগ্রাম এখনো চলমান । জনগণের আকাঙ্ক্ষিত বা প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।

ইত্তেফাক: রাজনীতির মাঠে এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গটি জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে । আপনার মতামত শুনতে চাই ।

আবদুল আউয়াল মিন্টু: আমরা এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ বছরের শেষ কিংবা আগামী বছরের শুরুতে সরকার নির্বাচন দেবে বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো মহল কর্তৃক নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে । তাই মানুষ ভাবছে, নির্বাচন আসলে কখন হবে? কিন্তু আমাদের লক্ষ্য একটাই, সেটি হচ্ছে দ্রুত নির্বাচন ।

প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কার নিয়ে। সংস্কার বিষয়টি বহুমাত্রিক। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি প্রজন্ম আগের প্রজন্ম থেকে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী । নতুন প্রযুক্তি নতুন প্রজন্মকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে । একটি সময় ছিল গবাদি পশুকে সম্পদ ধরা হতো। পরবর্তী সময়ে জায়গা-জমিকে সম্পদ হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু নতুন যুগে প্রযুক্তি এবং জ্ঞানকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন আছে । দেশকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে নিতে আমরাও সংস্কার চাই। সংবিধান, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ সব খাতেই সংস্কার করতে হবে। তবে কোনটা আগে, কোনটা পরে এবং কোনটা জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার করবে, সেটা আগে নির্ধারণ করতে হবে।

ইত্তেফাক: সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে তর্কবিতর্ক বেশ জমেছে। এ বিতর্ক কীভাবে থামানো যায়?

আবদুল আউয়াল মিন্টু: সাংবিধানিক সংস্কার অন্য কিছু থেকে আলাদা। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যে সামাজিক চুক্তি। একটি মৌলিক দলিল। জনপ্রতিনিধিসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংস্কারের কাজটি করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা না করে বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার করা না হলে সেটি টেকসই হবে না । সাংবিধানিক সংস্কার অবশ্যই হতে হবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে । সংবিধান সংস্কারের যে প্রস্তাবগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে আসবে, সেগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য তৈরি করতে হবে, যাতে করে নির্বাচিত সরকার সেগুলো মেনে চলতে বাধ্য হয়।

ইত্তেফাক: নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বে খুব আলোচিত বিষয় । বাংলাদেশেও কি এ ধরনের কিছু দেখেছেন আপনি?

আবদুল আউয়াল মিন্টু: নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র পৃথিবীর বহু দেশে ছিল। এই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে কিছুসংখ্যক দেশ স্বল্প সময়ের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে তেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। তাছাড়া প্রথম দিকে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনসমর্থন বাড়ানো গেলেও পরবর্তী সময়ে তা আর ধরে রাখা যায় না। এক পর্যায়ে শাসকরা নিজেরাই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে । এই ব্যবস্থায় কোনো টেকসই প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন হয় না। তাছাড়া ঐ ক্ষমতাবানরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকীকরণ করে ও নিজেদের দখলে নিয়ে দুর্বল করে দেয়। একই সঙ্গে তারা নানা ধরনের জনপ্রিয় কর্মসূচি হাতে নেয় । তাতে সমাজে দিনদিন বহুমাত্রিক বৈষম্য বেড়ে যায়, বিশেষ করে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য।

ইত্তেফাক: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনকার বড় মাথাব্যথার কারণ । এর উন্নতি করা যায় কীভাবে?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের মধ্যে কনফিডেন্সের অভাব রয়েছে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । তারা অনেক সময় অপরাধীদের ধরে পুলিশকে দিচ্ছে । তবে পুলিশের উপস্থিতি কম । তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা পালন করছে না। দেশে স্থিতিশীল রাজনীতি বা সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আমার বিশ্বাস, নির্বাচনের পর জনগণ এবং সর্বমহলের মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে । তা না হলে সমাজের প্রতিটি গোষ্ঠী চেষ্টা করবে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের।

ইত্তেফাক: রাজনীতিবিদের পাশাপাশি আপনি ব্যক্তি খাতেরও একজন প্রতিনিধি । বিনিয়োগ প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?

আবদুল আউয়াল মিন্টু: উন্নয়নশীল দেশের বিনিয়োগকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর একটি হচ্ছে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো, আর অন্যটি হচ্ছে উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ৪৬ শতাংশ লোক কৃষি খাতে নিয়োজিত। ১৯৭৫ সালে এ খাতে জড়িত ছিল দেশের ৮৫ শতাংশ লোক। প্রতি বছরই লোক কমছে কৃষি খাতে। তাছাড়া প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ লোক নতুন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে । এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আগের বছরের বেকারের সংখ্যা । আমাদের মতো দেশে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, আমদানিও কমবে । দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। আমাদের দেশের যুবকরা মাদকের দিকে ঝুঁকছে । এ থেকে তাদের ফেরাতে হলে উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এজন্য প্রয়োজন পরিবেশ। বিনিয়োগের অন্যতম উপাত্ত হচ্ছে পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে একজন বিনিয়োগকারী, তিনি দেশি বা বিদেশি যা-ই হোন না কেন, বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। গত ১৫ বছরে এ দেশের পরিসংখ্যান চলেছে মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে । আবার বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনও তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেনি। অতএব বিনিয়োগ বাড়াতে হলে প্রথমে প্রয়োজন স্থিতিশীল সমাজ ও রাজনীতি।