জন্মের পরই নিবন্ধন জটিলতায় শিশুরা

প্রকাশিত: ১২:৪৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৬, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

  •  ৬ অক্টোবর জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস
  •  দক্ষিণ সিটি ৮৭ হাজার ‘ভুয়া’জন্ম সনদ বিতরণ করেছে
  •  উত্তর সিটিতে জন্ম সনদ বিতরণ বন্ধ রয়েছে

এক বছর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫ এর কার্যালয়ে ছেলের জন্ম সনদ সংগ্রহ করেন যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচার বাসিন্দা সৈয়দ খোরশেদ আলম। শিশুর স্কুলে ভর্তির জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় সেটি নিয়ে যান তিনি। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, এই জন্ম সনদ ‘ভুয়া’।

ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডের মেহেদী হাসান (৭)। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। গত জুন মাসে দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-১ থেকে ছেলের জন্ম নিবন্ধন করিয়ে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করেন মেহেদীর বাবা মোজাম্মেল হক। কিন্তু তার এ আবেদন গ্রহণ করেনি ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। পরে তারা এ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ‘দক্ষিণ সিটির এই জন্ম সনদের তথ্য জাতীয় সার্ভারে নেই।’

নাগরিক সেবার নামে গত প্রায় এক বছর ধরে এমন ৮৭ হাজার ‘ভুয়া’ জন্ম নিবন্ধন সনদ বিতরণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এসব সনদের কোনোটির সঙ্গেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) সার্ভারের তথ্যের মিল নেই। যারা ডিএসসিসি থেকে জন্ম সনদ নিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এসব সনদে দেশে কোনো ধরনের নাগরিক সেবা মিলছে না।

এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) জন্ম নিবন্ধন সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বছরখানেক আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী, জন্ম সনদ বিতরণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সম্প্রতি আবার আগের মতো ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিস থেকে জন্ম সনদ বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ কারণে এখন জন্ম নিবন্ধন আবেদন ও সনদ বিতরণ বন্ধ রয়েছে। এতে নাগরিক ভোগান্তি আরও বাড়ছে।

এ ধরনের শত শত অভিযোগ আসার মধ্যেই আজ রোববার (৬ অক্টোবর) জাতীয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস পালনকরছে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, আনবে দেশে সুশাসন।’ দিবসটি উদযাপনে আজ কাকরাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্টার জেনারেল কার্যালয় (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন)।
ডিএসসিসির কার্যক্রম
২০২৩ সালের জুন-জুলাই মাসের দিকে জন্ম নিবন্ধন ফি’র অর্থ নিজস্ব তহবিলে জমা হওয়ার দাবিতে নিবন্ধন বন্ধ রাখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। পরে ৪ অক্টোবর নিজস্ব সিস্টেম (সার্ভার হিসেবে অধিক পরিচিত) দিয়ে নিবন্ধনের কাজ শুরু করে ডিএসসিসি। বিষয়টিকে আইনবহির্ভূত জানিয়ে গত বছরের ১৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠান তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান।

জানুয়ারিতে নতুন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্চ, মে ও জুন মাসে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি পাঠিয়ে দক্ষিণ সিটির তৈরি নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করাকে আইনবহির্ভূত বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু তারপরও বিষয়টিকে আমলে নেয়নি দক্ষিণ সিটি। গত ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গোপনে দেশ ছাড়েন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। পরে গত ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগ অফিস আদেশ জারি করলে দক্ষিণ সিটির নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে নেওয়া শুরু হয়।

ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, আগে জাতীয় সার্ভারের মাধ্যমেই জন্ম সনদ বিতরণ করা হতো। কিন্তু সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের আপত্তিতে এই বিপত্তি ঘটে। তার নির্দেশেই আইন বহির্ভূতভাবে প্রায় সাড়ে ১০ মাসে দক্ষিণ সিটি থেকে ৭৮ হাজার ৯৫৬টি জন্ম নিবন্ধন এবং ১ হাজার ৪৭১টি মৃত্যু নিবন্ধন বিতরণ করা হয়েছে। এখন এসব সনদের তথ্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা নাগরিকদের তথ্যগুলো জাতীয় সার্ভারে যুক্ত করবেন।

গত প্রায় এক বছর ধরে দক্ষিণ সিটি থেকে যারা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করেছেন, তাদের কি আবার নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে কি না জানতে চাইলে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে বিতরণ করা সনদগুলো বাতিল হবে না। ওই নিবন্ধনগুলোর তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য শুধু জাতীয় সার্ভারে যুক্ত হবে। পরে শিশুদের স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্টসহ সব সেবা নিতে পারবেন নাগরিকরা।’

নিজস্ব সার্ভারে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করে ডিএসসিসি বেআইনি কাজ করেছে জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন বলেন, দক্ষিণ সিটির ৭৮ হাজার জন্ম নিবন্ধন জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করতে কাজ চলছে। এ নিয়ে ডিএসসিসি ও রেজিস্টার জেনারেল কার্যালয়ের কারিগরি একটি দল যৌথভাবে কাজ করছে। তবে এ নিবন্ধন কাজ কবে নাগাত শেষ হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ কাজটি করতে প্রচুর টাকা খরচ হবে। আমরা বলেছি, এ ব্যয় রেজিস্টার জেনারেল কার্যালয়ই বহন করবে, দক্ষিণ সিটি যাতে কারিগরি দিক দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করে।

ডিএনসিসির কার্যক্রম
২০২৩ সালে জনদুর্ভোগ কমিয়ে জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও সহজতর করতে কাউন্সিলর অফিস থেকে নাগরিকদের জন্ম নিবন্ধন বিতরণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এই নিবন্ধন কার্যক্রমে স্থানীয় কাউন্সিলর নিবন্ধক, কাউন্সিলর দপ্তরের সচিব সহকারী নিবন্ধকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন আঞ্চলিক অফিসে না গিয়ে কাউন্সিলর দপ্তর থেকেই সনদ সংগ্রহ করতেন নাগরিকরা।
তবে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে যান ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগপন্থি কাউন্সিলররা। এর মধ্যে ১৯ আগস্ট মেয়র ও ২৬ সেপ্টেম্বর সব কাউন্সিলরদের স্ব স্ব পদ হতে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এতে জন্ম নিবন্ধন সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

পরে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিকের স্বাক্ষরিত একটি অফিস আদেশে সব ওয়ার্ডের নাগরিক সেবা কার্যক্রম (নাগরিক সনদ, ওয়ারিশান সনদ, চারিত্রিক সনদ, অবিবাহিত সনদ, প্রত্যয়নপত্র, পারিবারিক সনদসহ অন্যান্য সনদ) পরিচালনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর এ সেবাগুলো সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অফিস থেকে সরবরাহ করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত আঞ্চলিক কার্যালয়ে জন্ম নিবন্ধন আবেদন জমা এবং সনদ বিতরণ শুরু হয়নি।

গত ২ অক্টোবর মেয়ে তাবাস্সুম আক্তারের (৬) জন্মনিবন্ধন করতে ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে (বনানী) যান কড়াইলের মোর্শেদ আলম। তখন তাকে কাউন্সিলর অফিসের লোকজন জানায়, এখন আর কাউন্সিলর অফিস থেকে সনদ দেওয়া হয় না। সনদের জন্য ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ে (মহাখালী) যোগাযোগ করতে হবে। পরে মহাখালী গেলেও তার আবেদন জমা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।
আলাপকালে মোর্শেদ আলম বলেন, তার এক পরিচিতজন তিন মাস আগে কাউন্সিলর অফিস থেকেই জন্ম সনদ নিয়েছেন। এখন বলা হচ্ছে, তারা সনদ দেয় না। আরেক জায়গায় যেতে বলা হচ্ছে। সেখানেও পেলাম না।

তবে আগের চেয়ে এখন জন্ম নিবন্ধনে ভোগান্তি বাড়বে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম সেন্টু। তিনি বলেন, আগে খুব সহজেই একজন নাগরিক কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জন্ম সনদ নিতে পারতেন। এখন সবাইকে দূরে আঞ্চলিক কার্যালয়ে যেতে হবে। আর আট থেকে ১০টি ওয়ার্ড মিলে একটি আঞ্চলিক কার্যালয় থাকে। একটি কার্যালয় থেকে এতো পরিমাণ মানুষকে সেবা দেওয়া কঠিন কাজ।

ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ডিএনসিসিতে ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। এখন ওয়ার্ডগুলোর জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পৃথক ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে বিতরণ করা হবে। এতে নাগরিকদের নির্দিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়েই আবেদন করতে হবে।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান  বলেন, তারা আগের মতোই জন্ম নিবন্ধন বিতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এখনো আঞ্চলিক অফিসগুলোতে কার্যক্রম শুরু হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আজ রোববার (৬ অক্টোবর) সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বৈঠক রয়েছে। আশা করি সপ্তাহখানেক পর কাজ শুরু করতে পারবো।

জন্ম নিবন্ধন করা কেন জরুরি
জন্ম সনদ হলো একজন মানুষের জন্ম, বয়স, পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ। রাষ্ট্রের স্বীকৃত নাগরিকের মর্যাদা ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে হলে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। এখন স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইন্সেন্স ইস্যুসহ দেশের ২২টির সেবা কাজে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর শিশুর জন্মের ৪৫ দিন বা দেড় মাসের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করতে হবে। তবে এ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন না করা হলে ১৮ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এটি করতে পারবেন। তবে ১৮ বছর পার হলে ৫০ টাকা ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, শিশুর জন্মগ্রহণের পর জন্ম-নিবন্ধীকরণ করার কথা বলা হয়েছে। উন্নত বিশ্বের সব দেশেই শিশু জন্মের পরই নিবন্ধন করা হয়। বাংলাদেশেও প্রতিটি শিশু জন্মের পর পর জন্ম নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা আছে। তাই আগের চেয়ে এখন মানুষ জন্ম নিবন্ধনে বেশি উৎসাহ পাচ্ছেন এবং সেবা কার্যক্রম সহজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়।
জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমরা সারাদেশে ৫৮ লাখ জন্ম নিবন্ধন করেছি। আরও ২৭ লাখ জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করা হয়েছে। এ হিসেবে প্রায় এক কোটি মানুষের সনদ বিতরণ করতে পেরেছি। আর এখন সার্ভারে ত্রুটি বা ধীর গতি নেই। খুব সহজেই নাগরিকরা সনদের জন্য আবেদন করতে পারছেন।