জেলা প্রতিনিধি,চট্টগ্রামঃ
সূর্যের আলো বের হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করে নিজের জন্য টিফিন নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যান তারা। দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে গাদাগাদি করে বাসে, সিএনজিতে চেপে বাসায় ফেরার সময় ঘরে রেখে যাওয়া পরিবারের ছোট সদস্যদের জন্য নিয়ে যান চিপস, চকলেট, বিস্কুট। অনেকেই আবার দায়িত্বটা একটু বাড়িয়ে পরিবারের জন্য বাজারও করে নিয়ে যান।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার নারী শ্রমিকদের জীবন এমনভাবেই চলছে। অনেকেই পরিবারের কথা ভেবে নিজেদের পড়াশোনার ইতি টেনে পরিবারের হাল ধরেছেন। অনেকেই স্বামীর অসুস্থতা কিংবা স্বামীর মৃত্যু বা অনুপস্থিতিতে নিজেদের পরিবারকে আগলে রাখছেন। এদের মধ্যে অনেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিশ্চিত করার জন্য খেটে যাচ্ছেন প্রতিদিন। আবার নিজের বিয়ের টাকা জোগাড় করতেও কাজ করছেন অনেকে।
উপজেলায় অবস্থিত কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড), সা’দ মূসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন এমন হাজার হাজার নারী। সকাল-সন্ধ্যা উপজেলার সদর, কালাবিবির দীঘি, চৌমুহনী, সেন্টার, বটতলী, সিইউএফএলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ভরে যায় নারী শ্রমিকদের পদচারণায়। বাস, সিএনজি, অটোরিকশা, জিপগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে বাড়ি ফেরার বা কর্মস্থলে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। বছর দশেক আগেও নারীরা নিজের ঘরের ভেতর থেকে কাঁথা সেলাই করা, টুপি বানানো, জাল তৈরি, বাঁশ আর পিতলের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করতেন। কিন্তু এখন মেয়েরা কাজের জন্য ছুটছেন শিল্পকারখানায়। বলা বাহুল্য, কাছাকাছি কাজের সুযোগ ও ভালো আয় এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
হাইলধর ইউনিয়নের মাহবুব নামের এক নির্মাণশ্রমিক বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ ১৪ বছর। একটা মেয়ে আর দুইটা ছেলে সন্তান রয়েছে। মেয়েটা ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে আর বড় ছেলেটা ৪র্থ শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলেটা নার্সারিতে পড়ে। বিয়ের সাত বছরের মধ্যে বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে আমি কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়ি। পরে আমার স্ত্রী কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করে। সে থেকে আমার স্ত্রীর রোজগার দিয়ে আমাদের পরিবার এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চলে।
তাসলিমা খাতুন নামের ৩৫ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ২০১২ সালের দিকে আমার স্বামী মারা যান। তখন আমার কোলে আমার দুই মেয়ে আর এক ছেলে ছিল। আমার বাপের বাড়ির লোকজন বলেছিল—ছেলেমেয়েদের তাদের দাদির কাছে রেখে অন্য জায়গায় বিয়ে বসতে। তবে আমি রাজি ছিলাম না। নিজের মধ্যে একটা জেদ কাজ করছিল যে, আমি আমার ছেলেমেয়েরে পড়াশোনা করিয়ে তাদের বাবার দায়িত্ব পালন করব। সেই থেকে আমি কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করি। এখন আমার বড় মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট ১ম বর্ষে, ছোট মেয়ে দশম শ্রেণিতে আর ছেলেটা ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। আমি হাল ছাড়িনি কখনো।
সাদিয়া নামের আরেক নারী শ্রমিক বলেন, ‘আমার বাবার আমরা চার মেয়ে। আমি সবার বড়। আব্বু দালান নির্মাণের কাজ করেন। কিন্তু আব্বুর একার পক্ষে পরিবারের খরচ সামলিয়ে আমাদের পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই এসএসসির পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কেইপিজেডে কাজ করা শুরু করছি।’
উপজেলায় অবস্থিত সা’দ মূসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র অফিসার এস এম পিন্টুর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করে। তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারী শ্রমিক। কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (কেইপিজেড) এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন নারী শ্রমিকদের সঠিক কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করে কাজ করে। বর্তমানে কেইপিজেডের বিভিন্ন সেক্টরে ২৭ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছেন। যার মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। আগামীতে ১ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগুচ্ছি। নারীরা সমাজে অবহেলিত ও নিপীড়িত। তাই কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের এই অগ্রাধিকার বজায় থাকবে।