টাইগারদের প্রিয় খাবার টোপ

প্রকাশিত: ৩:২০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৭, ২০২৪

ক্রীড়া ডেস্ক:

অনেকে নেহাতই শখের বশেই মাছ ধরেন। শৌখিন মৎস শিকারিদের মাছ ধরার সবচেয়ে পছন্দের পন্থা হচ্ছে বড়শি। মাছ ধরার বেশ প্রচলিত ও প্রাচীন এই রীতির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ—পানি না ছুঁয়েও মাছ ধরা যায়।বড়শিতে টোপ দিয়ে মাছকে প্রলুব্ধ করা হয়। ক্ষুধার্ত মাছ যখন টোপ দেখতে পায়, তখন ঝাঁপ দিয়ে টোপটা গিলে ফেলার চেষ্টা করে। আর অমনি বড়শিতে বিঁধে ঝুলে থাকে শূন্যে, বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। কারণ, পানি থেকে মাথাটা অনেক ওপরে বড়শিতে বিঁধে থাকে। শান্তদের অবস্থাও তেমনই। টোপ গিলে ফেলার পর শিক্ষা নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।গতকালের বাংলাদেশের ম্যাচটা যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে নাজমুল হোসেন শান্ত কীভাবে আউট হয়েছেন। বাংলাদেশ অধিনায়ককে রীতিমতো বড়শির টোপ দিয়ে মাছ বানিয়েছেন মোহাম্মদ নবি! শান্ত সুইপ কিংবা রিভার্স সুইপ ভালোই খেলেন। আর তার সেই শক্তির জায়গাতেই ফাঁদ পেতেছিল আফগানিস্তান।

শান্ত আর মিরাজের জুটি তখন বাংলাদেশকে সহজ জয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জমে উঠা এই জুটি ভাঙতে ২৬তম ওভারে একটা ফাঁদ বানালেন নবি। ডিপ স্কয়ার লেগ ফাঁকা করে দিলেন, ফাইন লেগেও কোনো ফিল্ডার ছিল না। তাই শান্ত জোর করে সুইপ করতে গেলেন, ব্যাটে-বলে ভালো টাইমিং না হওয়ায় ধরা পড়লেন শর্ট ফাইন লেগে। এত বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা একজন ব্যাটার, যিনি বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার অন্তত এই ফাঁদ সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত না?

শান্তর মতোই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেক প্রতিভাবান ব্যাটার ভাবা হয় সৌম্য সরকারকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার প্রায় এক দশক কেটে গেছে। অথচ এই ফাঁদ আর টোপের গল্প থেকে সৌম্যের চরিত্রটা বাদ দিতে পারলাম না। এই বাঁহাতি ব্যাটার গতকাল যেভাবে শুরু করেছিলেন, তার খেলা শট দেখাটা ছিল চোখের জন্য প্রশান্তি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই প্রতিপক্ষের খোঁড়া গর্তে নিজে গিয়ে পা বাড়িয়ে দিলেন!

১২তম ওভারে আজমতউল্লাহ ওমরজাই বোলিংয়ে ছিলেন। সৌম্যের জন্য ফাঁদ বানানো হয় উইকেটে পেছনে। ফাইন লেগে তার জন্য ফিল্ডার রেখে শরীরের ওপর খাটো লেংথে ‘টোপ’ দেন এই পেসার, ফাঁদে পা দিয়ে পুল করতে যান সৌম্য, তাতেই হয় ভুল। ফাইন লেগে দাঁড়িয়ে থাকা ফজল হক ফারুকি জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্যাচ নেন।

শান্ত-সৌম্যের এই ফাঁদ বুঝতে না পারার গল্প করতে গিয়ে আরেকটা শব্দ মনে পড়ে গেছে। ক্রিকেটে ‘গেম অ্যাওয়ারনেস’ বলে একটা কথা আছে। সহজ ভাষায় যার ব্যাখ্যা হল, ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেলা। বিশেষ করে ব্যাটারদের ক্ষেত্রে এটা বেশি প্রযোজ্য। কারণ উইকেট, প্রতিপক্ষ, বোলার ও ম্যাচের পরিস্থিতি সবদিক বিবেচনা করে ব্যাটারকে সময়ের সঙ্গে গিয়ার পরিবর্তন করতে হয়। যে ব্যাটারের গিয়ার পরিবর্তনের ক্ষমতা বা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য যত বেশি, তাকে তত বেশি দক্ষ ভাবা হয়। আর এই সবগুলো গুণ মিলেই তৈরি হয় গেম অ্যাওয়ারনেস।

‘গেম অ্যাওয়ারনেস’ ব্যাপারটার সঙ্গে সামর্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটাতে হলে গেম অ্যাওয়ারনেস থাকাটা জরুরী। যেটার ঘাটতি বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে। এমনকি প্রায় দেড় যুগ ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের মধ্যেও সেটার অভাব বোধ হয়।

গতকাল রশিদ খানের গুগলিতে যেভাবে বোল্ড হলেন মাহমুদউল্লাহ, সেটা দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আছেন। অফ স্টাম্পের বাইরে পিচ করা গুগলিতে ভুল পড়েছেন মাহমুদউল্লাহ, লেগ স্পিন ভেবে সামনের পায়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে তার ব্যাট আর প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল চলে যায় স্টাম্পে। চোখে সর্ষে ফুল দেখা মাহমুদউল্লাহকে অনুসরণ করেছেন মুশফিকও।

সাম্প্রতিক সময়ে মুশফিকের আলোচিত এক শটের নাম রিভার্স সুইপ। এই শটের সঙ্গে তার এতটাই প্রেম, যেন তার জন্য নিজেকেও বিলিয়ে দিতে রাজি তিনি! একধিক টেস্ট ম্যাচে দলের বাজে পরিস্থিতির মধ্যেও অতি বিলাসী এই শট খেলতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন মুশফিক! অথচ তার মতো একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছ থেকে গেম অ্যাওয়ারনেসটা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত। অবশ্য গতকাল মুশফিক রিভার্স সুইপ করার মতো সুযোগ পাননি! গাজানফারের ক্যারম বল অন্ধের মতো পড়েছেন মুশফিক! অফ স্পিন ভেবে সামনে পা এগিয়ে ফ্লিক করতে চেয়েছিলেন, তাতে লাইন মিস করেন মুশফিক। তবে ক্রিজে পা রাখার আগেই উইকেট ভাঙতে ভুল করেননি উইকেটকিপার ইকরাম আলিখিল। যেভাবে আউট হলেন, তা ১৮ বছরের একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

মুশফিকের এমন আউটের সঙ্গে মিল ছিল ইনিংসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে আউট হওয়া তানজিদ হাসান তামিমের। এই তরুণ ওপেনার একই বোলারের একই বল পড়তে ভুল করেন। লো হওয়া ক্যারম বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি। তানজিদ এখন পর্যন্ত ১৬টি ওয়ানডে খেলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা খুব একটা কম সময়ও না। তার পরও তার টেকনিক কিংবা খেলার ধরনে কোনো উন্নতির ছাপ নেই। গতকাল যেভাবে আউট হয়েছেন, ঠিক তার অভিষেক ওয়ানডেতেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাহিশ থিকশানার বলে এভাবেই আউট হয়েছিলেন। ঠিক যেন কার্বন কপি!

তানজিদ তামিমকে না হয় অনভিজ্ঞ কোটায় ছাড় পেলেন! কিন্তু তাওহিদ হৃদয় কি তার আউটের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? ২৩৬ রানে লক্ষ্য তাড়ায় ১৩৮ রানে ৮ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। হাতে তখন ২ উইকেট থাকলেও ওভার বাকি ১৭। উইকেটে একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটার হৃদয়। এমন পরিস্থিতি তিনি আড়াআড়ি ব্যাটে টেনে স্লগ সুইপ করতে গেলেন। হয়েছেন বোল্ড। এই তার গেম অ্যাওয়ারনেস?

অথচ এই সফরে যাওয়ার আগেও তারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অফ সাইডে আপনার শটের রেঞ্জ কম সেটা নিয়ে কাজ করছেন কি না? জবাবে হৃদয় যা বলেছিলেন তার সারমর্ম এমন—বিশ্বের অনেক ব্যাটার আছে, যারা শুধুমাত্র অন সাইডে শট খেলে তারকা হয়েছেন। তাদের সমস্যা না হলে আমারও সমস্যা হবে না। সবমিলিয়ে ৬৩ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা একজন যদি এভাবে নিজের দুর্বলতা লুকানোর চেষ্টা করেন তাহলে তার উন্নতি করার ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কি স্বাভাবিক নয়?