আন্তর্জাতিক ডেস্ক রিপোর্টঃ
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার নিয়ে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট বিভক্ত নয়। দেশের মিডিয়াও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচারের রায় কোন দিকে প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ট্রাম্পের মামলার রায় আগামী ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে ব্যাপকভাবে। তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক, প্রত্যেক বিচারক ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এটিই যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের গণতন্ত্রের নতুন রূপ দেবে।
রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে: বর্তমানে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে বেশি। ফলে বিচার ট্রাম্পের পক্ষে গেলে তা বাইডেনের নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে একটা প্রধান বাধা হিসেবেই দেখা দেবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, এই বিচার এখন আগামী নির্বাচন তথা রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট চারটি রাজনৈতিক ইস্যুর কথা বলেছে। প্রথমত, জনগণকে এই রায় দিয়ে প্রভাবিত করা যাবে কিনা যে, ট্রাম্প নির্বাচনের ফলে এবং নির্বাচনের প্রচারণায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন। কারণ জনগণের একটা বড় অংশ চায় না যে, ট্রাম্পকে আগামী নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। তারা মনে করেন না যে, কোনো নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হলে তা বলতে কাউকে নিষেধ করা উচিত বা তাকে স্তব্ধ করে দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত, জনমত কোন দিকে যাবে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মূলত তিনটি মামলা গুরুত্বপূর্ণ। পর্নো তারকার মুখ বন্ধ রাখতে ঘুষ দেওয়ার মামলা, নির্বাচনের ফল পালটে দেওয়ার মামলা এবং ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলা মামলা। কিন্তু এসব মামলা নিয়ে জনমতের পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১৮ সালে দেখা যায়, ৩১ থেকে ৪১ শতাংশ মার্কিনি মনে করেন, পর্নো তারকাকে ঘুষ দেওয়ার ঘটনায় ট্রাম্প অবৈধ কিছু করেছেন। আর গত বুধবার কুইনিপ্যাক ইউনিভার্সিটির জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৪৬ শতাংশ মনে করেন, ট্রাম্প এক্ষেত্রে অপরাধ করেছেন।
তৃতীয়ত, ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন পর্নো তারকার মামলায় যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায় কি না। যদিও প্রসিকিউটররা দাবি করেছেন যে, এর পক্ষে প্রমাণ আছে। তার বক্তব্যের সঙ্গে মার্কিন ট্যাবলয়েড দ্য ন্যাশনাল ইনকুয়েরারের প্রকাশক ডেভিড পেকারের বক্তব্যের মিল পাওয়া গেছে। তারা দুই জনই বলছেন যে, ট্রাম্প পর্নো তারকাকে ঘুষ দিয়ে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছেন বা সুবিধা নিয়েছে। তিনি তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশে বাধা দিয়েছিলেন। চতুর্থত, ট্রাম্প কেমনটা খেলবেন? তার বিচার নিয়ে বড় ধরনের সংকট যে সৃষ্টি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেন না। ট্রাম্প চলমান মামলা নিয়ে আদালতের বাইরেও কথা বলছেন। তিনি বিচারক এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। আদালতের বিষয় বাইরে যাতে না যায় সেই বিষয়ে আদেশ দিয়েও তাকে থামানো যায়নি। ফলে তার বিরুদ্ধে রায় গেলে তা দেশকে কোনদিকে নিয়ে যাবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
সুপ্রিম কোর্টে যে কারণে বিভক্তি: ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি এক বিশ্লেষণে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রার্থী হতে পারবেন বলে এর আগে রায় দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট। অথচ কয়েকটি রাজ্য তার নির্বাচনি ব্যালটে ট্রাম্পকে নিষিদ্ধই করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল কোনো অঙ্গরাজ্য কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত জানাতে পারে না। এবার ট্রাম্পের দায়মুক্তি নিয়ে চলা মামলায় সুপ্রিম কোর্টে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। কারণ এই রায় দেশের গণতন্ত্র তথা আগামী নির্বাচন কোন দিকে যাবে সেদিকেই বেশি প্রভাব রাখবে। এমনকি রায় দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে কি না, তা নিয়েও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্প সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়মুক্তির যে আবেদন করেছিলেন তা নিয়ে শুনানি হয়। প্রায় তিন ঘণ্টার শুনানিতে বিচারকদের মধ্যে স্পষ্ট বিভক্তি লক্ষ্য করা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট পর্যালোচনা করেছে যে, দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচার থেকে দায়মুক্তি পাবেন কি না এবং এমন সুযোগ থাকলে তার অর্থ আসলে কী দাঁড়ায়। এর জবাবই নির্ধারণ করবে যে ২০২০ সালের নির্বাচকে নস্যাত্ করার চেষ্টার অভিযোগে ট্রাম্প বিচারের মুখোমুখি হবেন কি না।
বিচারকরা যে প্রশ্ন তুলেছেন তা তাদের মধ্যে বিভক্তির একটি ইঙ্গিত মিলেছে। ফলে একটি বিভক্ত সিদ্ধান্তই আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বিভক্তির জেরে আরো জটিল সিদ্ধান্তও আসতে পারে, যা পুনরায় বিচার শুরুর প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে। তাদের প্রশ্নগুলো এটিও প্রকাশ করছে যে, রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উদারপন্থি সংখ্যালঘু উভয়েই ইতিহাসের দিকে চোখ রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে চান।
রক্ষণশীলরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের কিছুটা দায়মুক্তি থাকা উচিত। তবুও বিচারকরা এ মামলায় ট্রাম্পের আইনজীবী ডিন জন সাউয়ের যুক্তিতর্ক নিয়ে সতর্ক, যেখানে তিনি বলেছেন, একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচার প্রক্রিয়া থেকে ‘প্রায় সুরক্ষিত’। সাউয়েরকে এই সুরক্ষার বিষয়টি ধরে ৯ জন বিচারক জেরা করেছেন। ‘প্রেসিডেন্ট যদি সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান ঘটাতে বলে তাহলে কী হবে’, তিন উদারপন্থি বিচারকের একজন এলেনা কাগান এই প্রশ্নটি করেছেন। সাউয়েরকে বেশ দ্বিধান্বিত দেখা গেছে এর উত্তর দিতে গিয়ে। তিনি বলেছেন ‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে’। পরে আরেক জন উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত বিচারপতি কেতানজি ব্রাউন জ্যাকসনও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে, সাবেক প্রেসিডেন্টরা পুরো ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলে তারাতো আইন নাও মানতে পারেন।
বিদেশের মাটিতে সহিংস হামলার নির্দেশ যদি কোনো প্রেসিডেন্ট দেন তাহলে কী হবে, পরে কি তার বিচার করা যাবে—বিচারপতি ক্লেয়ারেন্স থমাস জানতে চান। বিচারক আলিতো আরেকটি সম্ভাব্য পরিণাম নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, প্রেসিডেন্ট দলীয় হামলারও শিকার হতে পারেন, তার উত্তরসূরি দ্বারা কিংবা মেয়াদের শেষে অফিস ছাড়ার পর। রক্ষণশীল বিচারকরা একই অবস্থান ব্যক্ত করেননি। বিচারপতি এমি কোনে ব্যারেটকে নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তাকে কিছুটা সন্দেহগ্রস্ত মনে হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট পূর্ণ দায়মুক্তি পাওয়ার অধিকারী কি না—তা নিয়ে।
মিডিয়াও বিভক্ত : যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার মধ্যেও ট্রাম্পের মামলা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ট্রাম্পের মামলাকে ফক্স নিউজ (দেশটিতে সবচেয়ে বেশি দর্শক আকৃষ্ট করে চ্যানেলটি এবং রিপাবলিকানপন্থি) তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। তারা বরং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আবার নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত এমএসএনবিসি ট্রাম্পের মামলাকেই সারা দিন গুরুত্বসহকারে প্রচার করেছে।