ট্রেনে নাশকতার শঙ্কায় নিরাপত্তা জোরদার

# রেল স্টেশন-বগিতে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা # প্রবেশপথে তল্লাশির মুখে যাত্রীরা # দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনের ধীরগতি

প্রকাশিত: ১০:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২৪

এসএম দেলোয়ার হোসেন:

দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নিরাপদ বাহন হ”েছ ট্রেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন ¯’ানে হরতাল-অবরোধের আড়ালে নিরাপদ এই বাহনে একের পর এক নাশকতা কর্মকাÐ ঘটিয়েছে দুর্বৃৃত্তরা। বগি লাইনচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি অগ্নিসংযোগে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন এ পর্যন্ত ৯ জন যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। এদিকে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ ও রেললাইনের সøীপার ক্লিপ খুলে ফেলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হলেও যাত্রী সাধারণের মধ্যে নাশকতার শঙ্কা কাটেনি। এমন পরি¯ি’তিতে যাত্রী সাধারণের চলাচল নির্বিঘœ করতে ও ট্রেনে নাশকতা এড়াতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে রেলের বগি ও স্টেশনগুলোতে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এ কার্যক্রম শুরু করেছে রেলওয়ে পুলিশ। প্রথম পর্যায়ে আন্তনগর ট্রেন, এবং পরবর্তী সময়ে বাকি ট্রেনগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। অপরদিকে রেলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রবেশপথে যাত্রীদের তল্লাশি কার্যক্রম শুরু করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এছাড়া বগিতে ওঠা যাত্রীদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ ভিডিও ধারণ করা হ”েছ। নাশকতামূলক দুর্ঘটনা এড়াতে ধীরগতিতে চালানো হ”েছ ট্রেন। আজ শনিবার (১৩ জানুয়ারি) রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ১৬ নভেম্বর রাতে টাঙ্গাইল স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের কোচে আগুন দেয় দূর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় ট্রেনটির দুটি কোচ পুড়ে যায়। ঘটনার দুদিন না যেতেই ১৯ নভেম্বর আরেকটি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে জামালপুরের সরিষাবাড়ী স্টেশনে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে। এ ঘটনায় ট্রেনটির দুটি কোচ পুরোপুরি পুড়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও একটি কোচ। এর ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে সিলেট রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি কোচে আগুন ধরিয়ে দেয় দূর্বৃত্তরা। এরপর ১৩ ডিসেম্বর রেলওয়ের ভাওয়াল গাজীপুর এবং রাজেন্দ্রপুর সেকশনে ২০ ফুট রেললাইন কেটে ফেলে দুর্বৃত্তরা। কেটে ফেলা ওই রেললাইনে দুর্ঘটনায় পড়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন। ট্রেনের ইঞ্জিন এবং ৬টি কোচ লাইন থেকে ছিটকে পড়লে এক যাত্রী প্রাণ হারান। আহত হন অনেকে। ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় আবারও নাশকতার শিকার হয় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। সেদিন দূর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয় মা ও শিশু সন্তানসহ ৪ জন। আহত হয় আরও ১০ জন। সর্বশেষ চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগায় দুর্বৃত্তরা। এ আগুনে দগ্ধ হয়ে ৪ যাত্রী প্রাণ হারান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুদিন আগে এই ঘটনা নাড়া দেয় দেশবাসীসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে। নড়েচড়ে বসেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এ নিয়ে ট্রেনে দুর্বৃত্তদের নাশকতার আগুনে পুড়ে আজ শনিবার (১৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখাপর্যন্ত ৯ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। পৃথক এসব ঘটনায় দগ্ধ আরও ১০ জন ঢাকা মেডিকেলের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ইনস্টিটিউটে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।
এদিকে ঈশ^রদী থেকে ঢাকায় আসা ট্রেনের যাত্রী তরিকুল ইসলাম ও মোস্তাফিজুর রহমান নিউজ পোস্টকে বলেন, দেশের বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতে আমরা ভোগান্তিতে পড়ছি। যাত্রীরা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনে ঘটে যাওয়া নাশকতার আগুনে হতাহতের ঘটনায় আমরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছি। রেলের নিরাপত্তা বাড়ানো হলেও এখনো শঙ্কা কাটেনি। অজানা আতঙ্ক নিয়েই ট্রেনে যাতায়াত করছি।
ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন মাস্টার সাইফুল ইসলাম নিউজ পোস্টকে বলেন, প্রতিটি ট্রেন বিলম্বে চলাচল করছে। সবচেয়ে বেশি বিলম্বে চলছে চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন। এটি প্রায় আট ঘণ্টা বিলম্বে চলছে। নাশকতার বিষয়টি মাথায় রেখেই ট্রেনের শিডিউলে কিছুটা বিলম্ব হ”েছ।
ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট মহিবুর ইসলাম বলেন, রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিদের্শনা অনুযায়ী প্রতিটি ট্রেন গতি কমিয়ে চলছে। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হ”েছ।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ নিউজ পোস্টকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনে নাশকতা বেড়ে যাওয়ায় সব ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিনে ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করে। এটি কমিয়ে ৭৫ কিলোমিটার করা হয়েছে। রাতে ৬০-৭০ কিলোমিটার বেগে চললেও এখন তা কমিয়ে ৫০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়েছে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ট্রেনের সামনে-পেছনে এবং গুরুত্বপূর্ণ ¯’ানগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হ”েছ। প্রথমে যাত্রীদের কাছে যেসব ট্রেনের চাহিদা বেশি সেসব আন্তঃনগর ট্রেনে সিসি ক্যামেরা লাগানো হ”েছ। সে অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটই প্রাধান্য পা”েছ।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী নিউজ পোস্টকে বলেন, হরতাল-অবরোধে সরকারি বাহন ট্রেনকে ঘিরে নাশকতার ঘটনা ঘটছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের জানমালেরও ক্ষতি হ”েছ। নাশকতা এড়াতে রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ট্রেনে সিসি ক্যামেরা লাগানোর কাজ চলছে। প্রথমে কয়েকটি ট্রেনে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব ট্রেনের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, সিসি ক্যামেরা থাকলে নাশকতার পাশাপাশি ট্রেনে পাথর নিক্ষেপও রোধ করা যাবে। কেউ নাশকতা কিংবা পাথর নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটালে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। প্রথম পর্যায়ে সিসিটিভি মনিটরিং করা হবে রেলওয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, গত ১০ জানুয়ারি থেকে ট্রেনে সিসি ক্যামেরা লাগানো শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ত‚র্ণা নিশিতা, মহানগর প্রভাতী ও সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে সিসি ক্যামেরা লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি ট্রেনে ১২টি করে ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি ট্রেনগুলোকেও ক্যামেরার আওতায় আনা হবে।
এদিকে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) আনোয়ার হোসেন নিউজ পোস্টকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে শঙ্কা থাকলেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যে কোনো পরি¯ি’তি মোকাবিলায় প্র¯‘ত রয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। ইতোমধ্যেই গোপীবাগের ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড নবীসহ দুজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বাকিদেরও ধরতে কাজ করছে রেলওয়ে পুলিশসহ অন্যান্য সং¯’া। রেলভ্রমণ নিরাপদ করতে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রেল স্টেশনগুলোর প্রবেশপথে তল্লাশি করা হ”েছ। একই সঙ্গে সন্দেহভাজন যাত্রীসহ রেলে ভ্রমণ করা যাত্রীদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ট্রেনের বগিতে অব¯’ান করা যাত্রীদের গতিবিধি অনুসরণে ভিডিও ধারণ করা হ”েছ। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, হাওর এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেনে সিসি ক্যামেরা লাগানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি ট্রেনগুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে।
এসপি আনোয়ার হোসেন নিউজ পোস্টকে আরও বলেন, শুধু ট্রেনে সিসি ক্যামেরা লাগানো হ”েছ তা কিš‘ নয়, এর পাশাপাশি যেসব স্টেশনে আগে থেকে সিসি ক্যামেরা নেই সেখানেও সিসিটিভি বসানো হ”েছ। বিশেষ করে, ঢাকার রেলওয়ে স্টেশনগুলো পুরোপুরি সিসি ক্যামেরার আওতায় আসছে। যেকোনও নাশকতা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে এটি। কেউ নাশকতা করার চেষ্টা করলে তাকে চিহ্নিত করা সহজ হবে। তিনি বলেন, ট্রেনে ভ্রমণ করা কোনো যাত্রীই যাতে আতঙ্কিত না হন, সেজন্য সন্দেহভাজন কাউকে মনে হলে দ্রæত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ অথবা রেলওয়ে পুলিশ বা ট্রেনের নিরাপত্তায় থাকা সদস্যদের অবহিত করার আহŸান জানান রেলওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা।