ডায়ালাইসিস যন্ত্রের দরপত্রে ‘ষড়যন্ত্র’

প্রকাশিত: ১২:১৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৩, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

প্রকল্পটি যেন চড়ে বসেছে কচ্ছপের পিঠে। পাঁচ বছর পার হলেও নানা ফিকির আর ষড়যন্ত্রে এক আনা কাজও এগোয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ছেই। এ পর্যন্ত প্রকল্পের টাকা খরচ হয়েছে মাত্র দুই লাখ। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে গোঁজামিল দিয়ে তিন দফা দরপত্র আহ্বান করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

তবে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণ করতে না পারায় প্রতিবারই দরপত্র বাতিল করতে হয়। প্রকল্প গতিশীল না হওয়ায় কেনা যায়নি যন্ত্রপাতি। ফলে ৪৪ জেলার কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস সেবা এখনও অধরা থেকে গেছে।

কিডনি প্রতিস্থাপনে রয়েছে আইনি নানা জটিলতা। এ কারণে রোগীর বেঁচে থাকার ‘অন্ধের যষ্টি’ ডায়ালাইসিস। তথ্য বলছে, দেশে বছরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। এ রোগের চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। এ ছাড়া অধিকাংশ সেবাকেন্দ্র ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় চিকিৎসা নিয়ে অতল সাগরে পড়েন জেলা পর্যায়ের রোগীরা। এ বাস্তবতায় কিডনি চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ ও রোগীর ভোগান্তি কমাতে ২০২০ সালে প্রায় ২৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকার ‘১৫টি মেডিকেল কলেজে ও ৪৪টি জেলায় ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন’ নামে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল সরকার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কমিশন ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জটিলতার কারণে প্রকল্প আটকে যায়। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে এখনই শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী করা সম্ভব হবে না। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কেনাকাটায় জটিলতা তো আছেই। তবে জনবল নিয়োগ না হওয়া ও স্থান সংকটের কারণে এখনও শুরু করা যায়নি প্রকল্পের কাজ।

এ পটভূমিতে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আপনার সুস্থ কিডনি কি সুস্থ? দ্রুত শনাক্তকরণ ও কিডনির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করুন’। কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আজ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং সংগঠন শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা করবে।

এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, দেশে এখন কিডনি রোগী প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। একজন রোগীর নিয়মিত ডায়ালাইসিস সেবা নিতে মাসে গড়ে ৪৬ হাজার ৪২৬ টাকা খরচ হয়। ৯২ দশমিক ৮৭ শতাংশ পরিবারই এই খরচ চালাতে গিয়ে আর্থিক সমস্যায় পড়ে। সাড়ে ১৯ শতাংশ রোগী প্রয়োজনের চেয়ে কম ডায়ালাইসিস করান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫টি মেডিকেল কলেজে ৫০ শয্যা করে আর ৪৪ জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা জটিলতায় সেটি থেমে আছে।

প্রকল্পের জিডিই-১ লটের আওতায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর আট মেডিকেল কলেজ ও ১৬ জেলার জন্য ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে প্রাক্কলন খরচ ধরা হয় ৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। এতে চার প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। তবে দরপত্রে এমন নির্দেশাবলি (স্পেসিফিকেশন) দেওয়া হয়, যাতে নিপ্রো-জেএমআই ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিতে না পারে। নিপ্রো-জেএমআই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক। করোনাকালে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সে সময় তিনি গ্রেপ্তারও হন।

জিডিই-১ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জিডি-২ লটে ডায়ালাইসিস যন্ত্রের ১২ ইঞ্চি বা এর চেয়ে বড় টিউনাবল টাচ স্ক্রিনের শর্ত দেওয়া হয়। তবে জিডি-১ লটে ১০ ইঞ্চি বা এর চেয়ে বড় টিউনাবল টাচ স্ক্রিন চাওয়া হয়। প্রকল্পের ২০২২ সালের কেনাকাটায় ডায়ালাইসিস মেশিনের ডায়ালাইসেট ফ্লোরেট ৩০০-৮০০ মিলি/ মিনিটের মধ্যে হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। তবে এই লটে ফ্লো রেট চাওয়া হয়েছে ২০০-৮০০ মিলি/ মিনিট। জিডিই-১ প্রকল্পের কেনাকাটায় হেমোডায়ালাইসিস ফাংশন (এইচডিএফ) চাওয়া হয়েছে। এর আগে ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটার দরপত্রে এইচডিএফ চাওয়া হয়নি। সরবরাহকারীকে পাঁচ বছরের মধ্যে একটি দরপত্রে শুধু ডায়ালাইসিস যন্ত্র কেনাকাটায় ৭০ কোটি কিংবা তার বেশি টাকার যন্ত্র সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পে ২০২২ সালের জিডি-২ লটের কেনাকাটায় পাঁচ বছরের মধ্যে আলাদা দুটি দরপত্রে ২২ কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।

এমন শর্ত ও অনিয়মের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেন একাধিক দরদাতা। পরে ওই দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। এরপর তিনবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও যোগ্য দরদাতা নির্বাচন করা যায়নি। এরই মধ্যে তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গত পাঁচ বছরে প্রকল্পের মাত্র দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কাজের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতিও নেই। প্রকল্প পরিচালক বদল হয়েছেন পাঁচজন।

এখন প্রকল্পের পরিচালক কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ এহসান জলিল। তিনি সমকালকে বলেন, ডায়ালাইসিস স্থাপন প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছি দুই সপ্তাহ হলো। আগের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। জুনের মধ্যে কেনাকাটা করা সম্ভব নয়, এটা বলতে পারি। প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার একটি বৈঠক আছে। বৈঠকের পর প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব।

বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিডনি রোগী। তবে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে চিকিৎসা করাতে পারেন না। এ জন্য জেলা পর্যায়ে ডায়ালাইসিস ইউনিট করা গেলে কিডনি রোগীর চিকিৎসা খরচ কমানো যেত।

জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, যন্ত্র কেনাকাটায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব নেই। তবে টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জটিলতার কারণে এসব প্রকল্প আটকে যায়। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দেওয়া হয় বিভিন্ন শর্ত। এতে অন্য যোগ্য কোম্পানিগুলো বাদ পড়ে। এখানে লাগে বিপত্তি। এতে বছরের পর বছর আটকে যায় প্রকল্পের কাজ। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীকে। দেশে মোট রোগীর মাত্র ২০ শতাংশ ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায়। ৪৪ জেলায় ডায়ালাইসিস সুবিধা নিশ্চিত হলে এই সেবার জন্য মানুষকে ঢাকামুখী হতে হতো না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের লোকজন জানে এই প্রকল্প কার কারণে আটকে রয়েছে। কমিশনখোর ব্যক্তিদের এই প্রকল্প থেকে বের করে দেওয়া জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক মো. মঈনুল আহসান বলেন, একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে অবকাঠামো নির্মাণে জন্য জায়গা নির্বাচন করা হয়। অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল জায়গা দিতে পারেনি। এ ছাড়া কেনাকাটায় জটিলতা তো রয়েছেই। কেনাকাটা শেষ হলে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে পাঁচ বছর পেরোলেও এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই– এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান সমকালকে বলেন, প্রকল্পটির দরপত্রের শর্তে কিছু ত্রুটি থাকায় এতদিন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রত্যশা, দ্রুত সময়ে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।