নওগাঁ প্রতিনিধিঃ
সড়কে ভারি যানবাহন চালানোর ক্ষেত্রে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যা ইস্যু করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এই লাইসেন্স দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি ১০ বছর মেয়াদি অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স। আরেকটি ৫ বছর মেয়াদি পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স।
বিআরটিএ সেবা বাতায়নের তথ্য মতে, একজন চালককে অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ৫ হাজার ৭৫ টাকা থেকে সর্ব্বোচ্চ ৫ হাজার ৩০৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। বিপরীতে একজন চালককে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয় ৩ হাজার ৩৫০ টাকা থেকে সর্ব্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৮০ টাকা।
তবে নওগাঁ বিআরটিএতে এ হিসাব শুধুমাত্র টাকা জমার অনলাইন রশিদেই সীমাবদ্ধ। নিজেদের গড়ে তোলা দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের নিয়মবহির্ভূতভাবে লাইসেন্স দিয়ে কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করছেন সংস্থাটির নওগাঁ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ ও মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান। তাদের ডান হাত আতিক। সার্বক্ষণিক লাইসেন্স সংক্রান্ত ফাইল হাতে নিয়ে থাকেন ইন্সপেক্টরের সঙ্গেই। এ চক্রে আরও রয়েছেন আব্দুল কুদ্দুস, সাকিব, শামীম, শুভসহ অন্তত ১২০ জন দালাল।
এ চক্রের মাধ্যমে না গিয়ে কেউ নিজে নিজে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করলে ফাইল ছুঁয়েও দেখেন না এডি ও ইন্সপেক্টর। খোদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অফিস সংলগ্ন নিচ তলায় ঘুষ লেনদেনকে নিয়মে পরিণত করেছেন এই দুই কর্মকর্তা। সেবাগ্রহীতাদের কয়েকটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে লাইসেন্স প্রতি কমপক্ষে ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ ও মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসনের বিরুদ্ধে।
যদিও বিআরটিএর নওগাঁ সার্কেলের এই বেহাল দশা এক-দুদিনে হয়নি। ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেল অফিসে মোটরযান পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। তার সময়ে অফিসটি দুর্নীতি ও প্রকাশ্য ঘুষ গ্রহণের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর তিনি অন্য জেলায় বদলি হোন। এরপর অফিসটিতে দুর্নীতি ও প্রকাশ্য ঘুষ লেনদেন কিছুটা কমে এসেছিল। সেই সাথে দাপুটে দালালদের দৌরাত্ম্যও কমে।
এরই মধ্যে ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল মোটরযান পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন ফয়সাল হাসান। তিনি যোগদানের পর ফের শুরু হয় প্রকাশ্য ঘুষ লেনদেন। ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল নওগাঁ বিআরটিএতে সহকারী পরিচালক (এডি) হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে আবারো যোগদান করেন প্রাক্তন মোটরযান পরিদর্শক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। এরপর অফিসটিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত নওগাঁ জেলা কার্যালয় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করেও এ অফিসে পরিবর্তন আনতে পারেনি।
মোটরযান অধ্যাদেশ আইন অনুযায়ী- কোনো চালককে পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)। এ বোর্ডে সভাপতির দায়িত্বে আছেন নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আব্দুল করিম। তার নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) গাজিউর রহমান, সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. আশীষ কুমার সরকার, টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজির ইন্সট্রাক্টর আব্দুল হামিদ সদস্য পদে রয়েছেন। এছাড়াও সদস্য সচিব হিসেবে আছেন বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান।
অর্থাৎ লাইসেন্স দেওয়ার আগে চালকের দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ রয়েছে বিআরটিএর বাহিরেও একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার। তবে পরীক্ষা চলাকালে বেশিরভাগ সময়েই অনুপস্থিত থাকেন ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ডের (ডিসিটিবি) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। মূলত এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই অদক্ষদের মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছেন এডি ও ইন্সপেক্টর। এতে বেপরোয়া গতিতে অদক্ষ চালকদের মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
গত সোমবার (২৯ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেল অফিসে গিয়ে দেখা যায়, লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে শতাধিক পরীক্ষার্থী বায়োমেট্রিক দেওয়ার জন্য অফিসের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। দালালরা এসে মাঝে মধ্যেই তাদের আশপাশ ঘুরে যাচ্ছেন। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই তাদের থেকে ঘুষের টাকা আদায় করছেন অনেক দালাল। এরপর সেই টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসানের ক্যাশিয়ার ও ডান হাত হিসেবে সুপরিচিত আতিকের কাছে। টাকাগুলো পকেটে নেওয়ার পর যারা ঘুষ দিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে শুধুমাত্র নাম ও রোল খাতায় লিখে আসার নির্দেশনা দিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) পাঠিয়ে দিচ্ছেন দালালরা।
বিআরটিএ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাকিব নামে এক দালালকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার পর সেবাগ্রহীতা সেজে অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স করানোর সহজ উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র, সার্টিফিকেট ও বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপির সঙ্গে এক কপি ছবি নিয়ে আসতে হবে। লাইসেন্সের আবেদন করতে মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে হয়। এর কিছুই করতে হবে না। সব কিছুর ভুয়া কাগজ তৈরি করে লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়া হবে। বিআরটিএ অফিসে লাইসেন্সধারীদের ছবি তোলার কাজে নিয়োজিত কর্মচারী শাহজাহানকে নিজের নিকটতম বড় ভাই হিসেবে দাবি করেন তিনি।
অবৈধ এ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স করার খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাকিব বলেন, মোটরসাইকেল চালক হিসেবে সহজেই অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে ৯ হাজার টাকা দিতে হবে। এর সঙ্গে কার/লাইট সংযুক্ত করে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ক্ষেত্রে আরও ২ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হবে। তবে গাড়ি চালানোর দক্ষতা না থাকলে সেক্ষেত্রে ১৩ হাজার টাকার কমে ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলবে না। তখন বিআরটিএকে আরও বেশি ঘুষ দিতে হয়।
ওইদিন বেলা ১১টা ১০ মিনিটে শহরের থানার মোড় এলাকার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দূর-দূরান্ত থেকে আসা পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রের প্রবেশ পথে দাঁড় করিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছেন আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তি। কুদ্দুস পরীক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের রোল দেখে নির্ধারিত আসনে বসতে নির্দেশনা দেন। এরপর ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যে প্রত্যেককে তৃতীয় তলার ৩টি কক্ষে নিয়ে বসায় আব্দুল কুদ্দুস। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই ৩টি কক্ষে প্রবেশ করেন টিটিসির কর্মচারী নাজমুল ও সাবেক সহকারী প্রশিক্ষক আব্দুল জব্বারসহ ৪-৫ জন ব্যক্তি। যারা কেউই বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেল অফিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাদের হাতে পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্নপত্র বুঝিয়ে দিয়ে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান। এরপর পরীক্ষা শুরু হলে পরীক্ষার্থীদের দেওয়া প্রশ্নপত্রের উত্তর বলে দেন টিটিসির সাবেক সহকারী প্রশিক্ষক আব্দুল জব্বার। সে অনুযায়ী পরীক্ষার্থীরা ঝটপট তাদের খাতায় উত্তর লিখতে শুরু করেন।
সার্বিক বিষয়গুলো ৩টি কক্ষ ঘুরে ঘুরে বার বার দেখছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। নিজের পরিচয় গোপন রেখে পরীক্ষা চলাকালীন ওইসব কক্ষের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রতিবেদককে থামিয়ে দেন আব্দুল কুদ্দুস। ওই মুহূর্তে পরিচয় জানতে চাইলে নিজেকে বিআরটিএর কর্মকর্তা হিসেবে দাবি করেন আব্দুল কুদ্দুস। এরপর প্রতিবেদক নিজের পরিচয় প্রকাশ করা মাত্রই তৃতীয় তলা থেকে দৌঁড়ে নিচে পালিয়ে যান আব্দুল কুদ্দুস।
পরে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে আব্দুল কুদ্দুসের দেখা মেলে। সেখানে গিয়ে সঠিক পরিচয় জানতে চাইলে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমি বিআরটিএর কেউ নয়। মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে আসার পর পরীক্ষা নেওয়ার কাজে সামান্য সহযোগিতা করেছি। পরিচিত ৩ জন পরীক্ষার্থীর জন্যই মূলত আসা। মাঝেমধ্যে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের পরীক্ষার্থী পেলে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আসা হয়। টাকার বিনিময়ে বিআরটিএ অফিসকে ম্যানেজ করে কিছু কাজ করি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওইদিন টিটিসিতে আসা আরেক দালাল বলেন, আমিসহ অন্তত ১২০ জন দালাল পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে চুক্তি করি। প্রত্যেক লাইসেন্স বাবদ ৯ হাজার টাকা থেকে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সে ঘুষ বাবদ বিআরটিএ অফিসে ২ হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। নিরক্ষর পরীক্ষার্থীদের বেলায় আরও ৩০০ টাকা বাড়তি ঘুষ দিতে হয়। অপেশাদার লাইসেন্সের ধরন অনুযায়ী প্রত্যেক ফাইলে ঘুষ দিতে হয় ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এডি ও ইন্সপেক্টর ঘুষের টাকা আতিকের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। ঘুষ না পেলে ফাইল ছুঁয়েও দেখেন না তারা। চাহিদা মতো ঘুষ দিলে মাদকাসক্ত, নিরক্ষর ও অদক্ষ চালকদের সহজেই লাইসেন্স দেয় বিআরটিএ।
লিখিত পরীক্ষা শেষে ওইদিন দুপুর দেড়টার দিকে টিটিসির প্রবেশ পথে পরীক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে কৃতকার্য ও অকৃতকার্যদের ফলাফল ঘোষণা করেন টিটিসির সাবেক সহকারী প্রশিক্ষক আব্দুল জব্বার। ফলাফল ঘোষণা শেষে লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা কোন ক্ষমতা বলে নিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আগের প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বর্তমানে অ্যাসেট প্রকল্পের মাধ্যমে তিন বছরের জন্য প্রশিক্ষক হিসেবে আবারো টিটিসিতে নিয়োগ পেয়েছি। এখানে পরীক্ষা হওয়ায় স্বেচ্ছায় বিআরটিএকে সহযোগিতা করতে তাদের পরীক্ষায় এসেছিলাম। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর মানবিকতার খাতিরে পরীক্ষার্থীদের শিখিয়ে দিয়েছি। এতে তার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে দুপুর ২টার দিকে লিখিত পরীক্ষার পরবর্তী ধাপে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পরীক্ষার্থীদের আবারো তৃতীয় তলায় পাঠান আব্দুল জব্বার। সেখানে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীকে একটি কক্ষে বসান টিটিসির কর্মচারী নাজমুল। এরপর ওই কক্ষে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষার্থীদের সড়কে চলাচলের সময় বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন লক্ষ্য করতে পরামর্শ দেন মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান। প্রায় ৩০ মিনিট যাবত ইন্সপেক্টর বহুমুখী নির্দেশনা দেন পরীক্ষার্থীদের। এরপর ওই কক্ষে উপস্থিত হন সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. আশীষ কুমার সরকার। তিনিও একইভাবে সচেতনতামূলক বক্তৃতা দেন পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। তবে ডিসিটিবির বাকি ৩ জন সদস্যকে এই সময়ের মধ্যে একবারও টিটিসিতে আসতে দেখা যায়নি।
একপর্যায়ে বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে মৌখিক পরীক্ষা না নিয়েই প্রত্যেকের ব্যবহারিক পরীক্ষায় মোটরযান চালানোর দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য নিচ তলায় নিয়ে যান বিআরটিএর ইন্সপেক্টর। সেখানে প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে একে একে অদক্ষ বেশ কয়েকজন চালককে সবার সামনেই অকৃতকার্য ঘোষণা করেন তিনি।
ওইদিন ব্যবহারিক পরীক্ষায় অকৃতকার্যের তালিকায় ছিলেন নওগাঁর পত্নতলা উপজেলার আমান্তা চকমনোহর গ্রামের মো. মাসুদের নাম। ঢাকার সাভারে একটি গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তার রোল ছিল ৯। টানা দুই দফায় সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও ঠিকমতো গাড়ি চালিয়ে দেখাতে না পারায় ইন্সপেক্টর ফয়সাল তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করলে তিনি এক প্রকার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
ওই মুহূর্তে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মাসুদের। তিনি বলেন, পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে পরিচিত এক দালালের সঙ্গে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছে। ভুয়া ডোপ টেস্ট থেকে শুরু করে সব কিছু ম্যানেজ করে সে আবেদন করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে একবারও আমাকে আসতে হয়নি। দুই দফায় ৫ হাজার টাকা ইতোমধ্যেই পরিশোধ করেছি। শুধুমাত্র পরীক্ষায় এসে নামমাত্র অংশগ্রহণ করলেই পাস করানো হবে বলেও জানিয়েছিলেন দালাল। অথচ আমাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হলো। রমজান নামে ওই দালালকে কল করেছি। তিনি এখনো বলছেন পাস করিয়ে দেবেন।
মাসুদের থেকে তাৎক্ষণিক রমজানের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কল করা হলে নিজেকে মাইক্রোবাসের চালক হিসেবে পরিচয় দেন। এখানে অকৃতকার্য দেখানোর সুযোগ নেই জানিয়ে বিআরটিএতে তার লোক আছে বলে জানান রমজান। শেষ পর্যন্ত দালাল রজমানের এই কথাই সত্য হয়েছে। পরের দিন অনলাইনে প্রকাশিত ফলাফলে ঘুষের টাকার জোরে মাসুদকে কৃতকার্য দেখিয়েছে ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)।
একই ঘটনা ঘটেছে সাড়ে ৮ হাজার টাকা চুক্তিতে শুভ নামে আরেকজন দালালের মাধ্যমে আসা রাণীনগর উপজেলা কৃষি অফিসের কর্মচারী অসিয়ত জামানের ক্ষেত্রেও। অপেশাদার মোটরসাইকেল চালক হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নিতে এসে ওইদিন তার রোল ছিল ১৯১। মোটরসাইকেল চালিয়ে দেখাতে বললে ব্যর্থ হওয়ায় সবার সামনেই অসিয়ত জামানকে অকৃতকার্য ঘোষণা করেছিলেন ইন্সপেক্টর ফয়সাল হাসান। তবে ঘুষের টাকার জোরে পরের দিন অনলাইনে প্রকাশিত ফলাফলে অসিয়ত জামানকে কৃতকার্য দেখিয়েছে ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)।
বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেলের তথ্য মতে, গত ২০২৩ সালের মার্চ থেকে পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনকারীরা পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পর দুই সপ্তাহের মধ্যেই ড্রাইভিং স্মার্ট কার্ড পাচ্ছেন। ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্রুততম সময়ে ১৮ হাজার জন চালক এই স্মার্ট কার্ড ডেলিভারি পেয়েছেন। আরও ৬ হাজার স্মার্ট কার্ড ডেলিভারি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ডিসিটিবির সিদ্ধান্তে বর্তমানে প্রতি মাসে ৪টি করে পরীক্ষার বোর্ড অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রত্যেকটি বোর্ডে ২২০ জন করে পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছেন।
এদিকে ঘরে বসেই দ্রুততম সময়ে স্মার্ট কার্ড ডেলিভারি পেয়ে বিআরটিএর প্রশংসায় পঞ্চমুখ অনেক সেবাগ্রহীতা। আসিফ সোহান, মেজবা হাসান, ইশাতির রাদিসহ বেশ কয়েকজন উঠতি বয়সী মোটরসাইকেল চালক বলেন, দুই বছর আগেও যারা লাইসেন্স করতো, তাদের স্মার্ট কার্ড পেতে কমপক্ষে ৬ মাস থেকে ১ বছর অপেক্ষা করতে হতো। ৪ বছর আগে যারা লাইসেন্স করেছে তারা অনেকে কমপক্ষে ২ বছর পার হলে স্মার্ট কার্ড পেয়েছে। বিপরীতে আমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড পেতে এক মাস সময় লাগেনি। ঘরে বসে অল্প দিনের মধ্যেই স্মার্ট কার্ড ডেলিভারি পেয়েছি। আগে লাইসেন্স না থাকায় পুলিশের মামলায় অনেকবার জরিমানা দিতে হয়েছে। এখন আর জরিমানার মুখে পড়তে হয় না।
নওগাঁ জেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিউজ্জামান মতি বলেন, আমলাতান্ত্রিক দেশে সবকটা দপ্তরেই ঘুষ গ্রহণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিআরটিএ এর বাহিরে নয়। দালালের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স করাতে গেলে তবেই আমাদের মোটর শ্রমিকরা দ্রুত লাইসেন্স পায়। ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন ঘুরানো হয়।
ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে একজন ট্রাফিক পুলিশ চালকের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নওগাঁ সদর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) মুহাম্মদ আফজাল হোসেন নিউজ পোস্ট বিডিকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ আগে থেকে আরও কঠোর হয়েছে। কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া সড়কে গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোর চেষ্টা করলে অবশ্যই মামলার সম্মুখীন হতে হবে। নতুন গাড়ি কেনার আগে লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে ফাঁকা মাঠ বা উপযুক্ত ট্রেনিং সেন্টারে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে চালকদের প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করছে ট্রাফিক বিভাগ। গাড়ি চালানো শেখার পর বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তখনই চালকরা সড়কে গাড়ি চালাতে পারবেন।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গত মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) বিকেলে বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেল অফিসে গেলে সেখানে মোটরযান পরিদর্শকের কক্ষে প্রবেশের পরই দেখা মেলে তার ডান হাত ও ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত আতিকের। ওই মুহূর্তে আতিক লাইসেন্স সংক্রান্ত ফাইলগুলো নিয়ে মোটরযান পরিদর্শককে সহযোগিতা করছিলেন। এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সেখান থেকে সটকে পড়েন আতিক।
এরপর আতিকের পরিচয় ও বিআরটিএর সঙ্গে সম্পৃক্ততা সম্পর্কে জানতে চাইলে মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান বলেন, আতিক নামে এই অফিসের কোনো স্টাফ নেই। এখানে সে আমার খাবার আনা নেওয়ার কাজে অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত। আতিকের মাধ্যমে কোনো ঘুষ গ্রহণ করা হয় না বলেও দাবি করেন তিনি।
ডিসিটিবির অন্যতম সদস্যরা অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কীভাবে পরীক্ষার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে মোটরযান পরিদর্শক ফয়সাল হাসান বলেন, ডিসিটিবি বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। ওইদিন পরীক্ষায় টিটিসির কিছু স্টাফ আমাদের সহযোগিতা করেছেন। তবে পুরো পরীক্ষা নিজে উপস্থিত থেকে নিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, অফিসে না এসে ঘরে বসেই এখন যে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারছেন। শুধুমাত্র পরীক্ষার দিন বিআরটিএ অফিসে উপস্থিত হয়ে সব ধাপে পাস করলে সহজেই মিলছে ড্রাইভিং লাইসেন্স। চালকরা পাস করার পর ই-ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালাতে পারছেন। দুই সপ্তাহের মধ্যেই চালকদের ঠিকানায় ডাকযোগে স্মার্ট কার্ড পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তাই এখানে ঘুষ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।
দালাল ও বাহিরের লোকবল দিয়ে বিআরটিএর ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন অর রশিদ বলেন, বিআরটিএর স্টাফ ও পরীক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা চলাকালে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। গত সোমবার (২৯ জানুয়ারি) কারা এ পরীক্ষা নিয়েছে সেটি খোঁজ নিয়ে দেখব। আগামীতে বিষয়টি খেয়াল রাখা হবে।
মোটরযান অধ্যাদেশ আইন অনুযায়ী কোনো চালককে পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)। এ বোর্ডে সভাপতির দায়িত্বে আছেন নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আব্দুল করিম। বিআরটিএ’র ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তার। কোনো কারণে তিনি উপস্থিত হতে না পারলে তার পরিবর্তে সেখানে যাওয়ার কথা জেলা প্রশাসনের যে কোনো একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের। অথচ গত সোমবার (২৯ জানুয়ারি) ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় জেলা প্রশাসনের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি জানিয়ে সরাসরি কথা হয় নওগাঁর জেলা প্রশাসক গোলাম মওলার সঙ্গে। তিনি বলেন, ওইদিন এডিএমের পরিবর্তে জেলা প্রশাসনের আরেকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিআরটিএর পরীক্ষায় যাওয়ার কথা ছিল। তবে পরীক্ষার দিন ওই ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি আরেক কাজে বাহিরে অবস্থান করছিলেন। এজন্য তিনি যেতে পারেননি। আগামীতে যেন এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা হবে।
বিআরটিএ অফিস দালালমুক্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অভিযান পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।