ঢাকায় গত ৯ বছরে মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে

নিজেস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকায় গত ৯ বছরে মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বা ভালো বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। আর বিগত ২০২৪ সালে মানুষ সবচেয়ে ভালো বায়ুমান পেয়েছে মাত্র ২ দিন এবং সবচেয়ে খারাপ বায়ুমান ছিল ৩৫ দিন। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে কমপক্ষে ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (নিচ তলা) শফিকুল কবির মিলনায়তন ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস ২০২৫: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়’- শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশবিদরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) যৌথভাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ দেশে বায়ুর মান ভালো রাখতে ৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন।
মূল প্রবন্ধে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বাংলাদেশে অবস্থিত ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ঢাকার গত ৯ বছরের বায়ুমান সূচকের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকায় গত ৯ বছরের ৩১১৪ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বা ভালো বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে। তবে এক্ষেত্রে ৬২৪ দিন মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন সংবেদনশীল বায়ু, ৮৫৩ দিন অস্বাস্থ্যকর, ৬৩৫ দিন খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৯৩ দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করেন। ২০২৪ সালের সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের দিনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ ও ৩৫ দিন।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে কমপক্ষে ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ)-এর গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, য়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে বায়ু ও সিসাদূষণসহ বিভিন্ন দূষণ; যা শিশুদের আইকিউ হ্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের মাত্রা এত বেশি মাত্রায় দাঁড়িয়েছে যে, ঢাকা শহর এখন বসবাস করার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দিনদিন এই দূষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনই এই দূষণ বন্ধ করতে না পারলে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. শহীদুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির ফলে দেশে দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত সরকার উন্নয়নের নামে একের পর এক পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ ধ্বংস করেছে। আমরা চাই বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দেশের উন্নয়নে পরিবেশকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেবে।
বাপার সহসভাপতি ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি ও সলিড ওয়েস্ট কম্পোজড করে কৃষিতে ব্যবহারের মাধ্যমে দূষণ কমানোর দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বায়ুদূষণ বন্ধে যে ৯ দফা সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- দেশের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় পরিবেশ সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে; বায়ুদূষণকারী মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করে বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বাড়াতে হবে; বায়ুদূষণকারী পোড়ানো ইটের বিকল্প ব্লক ইটের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা; বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন, শিল্প কারখানা, গৃহস্থালি কাজসহ সকলব স্তরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামানো; ‘আইইপিএমপি’সহ বিদ্যমান জ্বালানি নীতিগুলোতে সংশোধন আনা এবং নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন করা; বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানায় বিশ্বমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মান নির্ধারণ এবং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা; সৌর, বায়ু এবং জলবিদ্যুৎ ও বায়োগ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া এবং গৃহঅভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ কমাতে গ্রামীণ পর্যায়ে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে সবুজ জ্বালানি নিশ্চিত করা।