ঢামেকে টাকা ছাড়া মেলে না হুইল চেয়ার-ট্রলি-শয্যা

প্রকাশিত: ৯:৩১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪

# প্রতি শয্যায় গুণতে হচ্ছে ৩-৫শ’ টাকা
# রাত বাড়লেই দুর্ভোগ বাড়ে কয়েকগুণ
# সিন্ডিকেটেই নিঃস্ব হচ্ছে রোগীরা

সাইফুল ইসলাম:
দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানেই টাকা ছাড়া ঘোরে না ট্রলির চাকা। বকশিস না দিলে মেলে না রোগীদের বহন করার হুইল চেয়ার। সহসাই পাওয়া যায় না ওয়ার্ডের শয্যা। রাত বাড়লেই রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে কয়েকগুণ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এই হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। চক্রের সদস্যরাই লালন-পালন করছেন বহিরাগত দালাল। এ চক্রই নানান কৌশলে প্রতিনিয়ত পকেট কাটছে রোগীর স্বজনদের। এর ফলে সেবা নিতে আসা রোগীরা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। অসুস্থ রোগীদের জরুরি বিভাগ, ওয়ার্ড ও বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য আনা-নেওয়া করতে সরকারিভাবে একজন হুইল চেয়ার বা ট্রলিম্যানও নেই। হয়তো তারই সুযোগ নিচ্ছে একটি মহল। তবে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আজ শনিবার (১০ ফেব্রæয়ারি) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেলের বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে ২৬শ’ শয্যা রয়েছে। তবে রোগী ভর্তি হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। এক শিফটে পরিচালিত বহির্বিভাগে গাইনী, শিশু, মেডিসিন, অর্থোপেডিক্স, ক্যান্সার, ইউরোলজি, নাক-কান-গলা, চক্ষু, ডেন্টাল, মেডিসিনসহ ১৭টি বিভাগে গড়ে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন প্রায় ৪ হাজার রোগী। এসব রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ দিচ্ছেন আরএস ডা. শামসুন্নাহার ওয়াজেদ ও আরপি ডা. শায়েখ আব্দুল্লাহসহ ৬৫ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন আরও অন্তত ২০ জন ইন্টার্ণ চিকিৎসক। বহির্বিভাগে ওয়ার্ড মাস্টার আবুল বাশারের অধীনে আনোয়ারসহ দু’জন সর্দারের তত্ত¡াবধানে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছেন ১৪০ জন কর্মচারি। এরমধ্যে ডেইলি বেসিস ৬০ জন ও সরকারিভাবে ৮০ জন কর্মচারি। এর বাইরে ওয়ার্ড মাস্টারের তত্ত্বধানে কাজ করছেন বহিরাগত কিরণমালা, পান্না ও সাজেদাসহ ১০-১৫ জন দালাল। এখানে ওটিতে একটি ট্রলি থাকলেও তা রোগীর সেবায় সবসময় নিয়োজিত থাকে না। অধিকাংশ সময়ই থাকে তালা মারা। মাঝেমধ্যে ডাক্তারের পরামর্শে রোগী বহনের ক্ষেত্রে ওই ট্রলি ব্যবহার করা হলেও রোগীর স্বজনদের গুণতে হয় ন্যূনতম ৫শ টাকা। এছাড়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কমিশন বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাইরের ডায়াগণস্টিক সেন্টারে। এদিকে দেশের স্বনামধন্য এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ দিয়ে দিনে-রাতে দূর দূরান্ত থেকে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী এসে গড়ে প্রতিদিন ভর্তি ও প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন ২-৩ হাজার রোগী। জরুরি বিভাগে ৩ শিফটে প্রতিদিন ৩০ জন কর্মচারি থাকার কথা থাকলেও ওয়ার্ড মাষ্টার রিয়াজের তত্ত্বধানে সর্দার স্বপনের অধীনে কাজ করেন ১১ জন। এর মধ্যে ডেইলি বেসিস ৬ জন ও সরকারি ৫ জন কর্মচারি রয়েছেন। হুইল চেয়ার কিংবা ট্রলিতে চেপে রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয় জরুরি বিভাগে। অথচ ডাক্তার অব্দি পৌঁছাতে ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের। হাসপাতালের বয়, নার্স কিংবা সর্দারদের সিন্ডিকেট পরিচালনা করে ট্রলি আর হুইল চেয়ার বাণিজ্য। সরকারি সম্পদ হলেও রোগীর স্বজনেরা যেনো এসব ব্যবহার করতে না পারেন সেজন্য তালা মেরে রাখা হয় ট্রলি আর হুইল চেয়ারে। ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি থাকা গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার রোগী এবং প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারের ওপরে রোগীকে টার্গেট করে গড়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। ট্রলি বা হুইল চেয়ার টানার কাজ যারা করছেন তাদের সবাইকে স্পেশাল বয় ও খালা বলে ডাকেন। ২৪ ঘণ্টাই এরা অবস্থান করছেন হাসপাতালের ভেতরে। ট্রলি বা হুইল চেয়ার ব্যবহারে রোগীপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন তারা। এছাড়া কোনো ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি হলে শয্যা ফাঁকা থাকলেও টাকা ছাড়া তা সহসাই মেলে না। প্রতিটি সিট বাবদ রোগীর স্বজনদের গুণতে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। হাসপাতালটিতে গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের সর্দারদের মধ্যে জরুরি বিভাগে রয়েছে ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ ও সর্দার স্বপন।
সূত্র জানায়, ঢামেক হাসপাতালে নতুন পরিচালক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বদলে যায় জরুরি বিভাগের দৃশ্যপট। রোগী হয়রানি ও দুর্ভোগ রোধে জরুরি বিভাগের বহিরাগত ট্রলিম্যান ও দালালদের বিতাড়িত করা হয়। এতে উৎকোচবঞ্চিত ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ ও সর্দার স্বপনসহ ১১ জন কর্মচারি নিজেদের ইচ্ছে মতো দ্বায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি এসব কর্মচারিরা জরুরি বিভাগে অবস্থান করলেও সহসাই কোনো রোগী বা ট্রলি টেনে ধরেন না। ডেইলি বেসিসের কর্মচারিরা সরকারিভাবে মাসে সাড়ে ১৭ হাজার টাকা বেতন পেলেও রোগী বহনকালে ট্রলি ধরতে গিয়ে কথিত বকশিসের নামে রোগী প্রতি ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকা আদায় করছেন। হাসপাতালের ভেতর কেবিন বøকে কাজী সাঈদ, বার্নে ফজলুল করিম, নতুন ভবনে ওয়ার্ড মাস্টার মো. রমিজ ও জিল্লুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে মো. দীনা ১২ জন কর্মচারি কাজ করছেন। নির্ধারিত সময় ছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিগন প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও ওয়ার্ড মাস্টরদের ম্যানেজ করে মাসিক হারে মাসোহারা দিয়ে হরহামেশাই হাসপাতালে ঢুকে পড়ছেন তারা। পুরাতন ভবনের বিভিন্ন ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেন। এছাড়া মোকলেস, আবু হানিফ, আব্দুল গফুর, বাবুল, ও স্বপনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে সব মিলে রয়েছে ৩০ জনের মতো সর্দার। প্রতিটি ওয়ার্ড মাস্টারের অধীনে কাজ করেন ৩ জন সর্দার। এরা দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেট গড়ে প্রকাশ্যে ট্রলি-হুইল চেয়ার ও সিট বাণিজ্য করে চললেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ঢামেক হাসপাতালে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জরুরি বিভাগের সামনে ট্রলি আর হুইল চেয়ার নিয়ে রোগীর অপেক্ষায় অন্তত ২০ জন স্পেশাল বয় ও খালা। অ্যাম্বুলেন্সে রোগী এলেই তার কাছে ছুটে যাচ্ছেন। রোগীর স্বজনরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুইল চেয়ার বা ট্রলিতে তুলে জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের কাছে নিচ্ছেন। সেখান থেকে চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী প্যাথলজি-এক্স-রে বিভাগ ও ওয়ার্ডে নিচ্ছেন। হুইল চেয়ার নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় ১৫ থেকে ২০ জন নারী। এদের মধ্যে পারুল, শারমিন, মমতাজ, রতœা ও শাহানাজ তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের লক্ষ্য থাকে, রোগীদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে টাকা আদায় করা। এরমধ্যে পারুল চাহিদামতো টাকা না পেলে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। পরিচয় গোপন রেখে কথা বলা এদের একজন নিজেকে জান্নাতের নানী পরিচয় দিয়ে বলেন, এক জায়গাতে রোগী নিয়ে যাওয়া-আসায় ২০০ টাকা। এছাড়া এক্স-রে করতে বা পরীক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া লাগলে রেট আরও বেশি লাগে। মো. শামিম নামের আরেক ট্রলিবয় জানান, হাসপাতালে অন্তত ৩০০ জন লোক ট্রলি টানছে। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টায় সার্ভিস দিয়ে থাকেন তারা। হাসপাতাল থেকে তাদের এক টাকাও দেওয়া হয়না। রোগীর স্বজনরা খুশি হয়ে যা দেন তাই নিই।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনরা জানান, পরিচিত কেউ না থাকলে সরকারি হাসপাতালে টাকা ছাড়া চিকিৎসা সেবা পাওয়া অনেক কষ্টকর। জরুরি বিভাগ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওয়ার্ডে ভর্তি করা পর্যন্ত রোগী প্রতি ধাপে ধাপে সবমিলিয়ে বখশিস দিতে হয় অন্তত ১ হাজার টাকা। ওয়ার্ডের সিট পাওয়া তো আরও কঠিন। ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ওয়ার্ড বয়দের হাতে তুলে দিলেই মিলে যায় কাঙ্খিত সেই সিট। তা না হলে মেঝেতেই মাদুর বিছিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হয় রোগীদের। দিনের বেলায় যেমন-তেমন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাসাপাতালে আগত রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে আরো কয়েকগুণ। তারা জানান, সরকারি এসব হাসপাতালে ২৪ ঘন্টাই তৎপর থাকে হুইল চেয়ার-ট্রলি সিন্ডিকেট। হাসপাতাল প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েও প্রতিদকার পান বলে বলে জানান ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনেরা।
কর্মচারি ফজলুল করিম বলেন, ঢাকা মেডিকেলে ২৫ থেকে ৩০ জন সর্দার আছে। ট্রলি ও হুইল চেয়ার টানার জন্য যারা আছে তাদের আমরা তিন শিফটে ভাগ করে দিয়েছি। এদের দেখভাল আমাদেরই করতে হয়। রোগীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায়ের বিষয়টি সত্য নয়, তিনি বলেন, এখানে কর্মরত ট্রলিম্যান যেহেতু সরকারিভাবে বেতনভুক্ত নয়, তাই রোগীরা স্বেচ্ছায় খুশি হয়ে যা দেয়, তাই ওরা নিয়ে থাকে। পুরাতন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমান ও আবুল বাশার আর নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেন হুইল চেয়ার নিয়ে নৈরাজ্যের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকা বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা জানান, ওয়ার্ড মাস্টাররা কখনোই এসব বিষয়ের সঙ্গে জড়িত নয়।
চিকিৎসকরা জানান, রোগীসেবার ব্রত নিয়েই সবাইকে কাজ করা উচিৎ। এছাড়া হাসপাতালে প্রশিক্ষিত ট্রলিম্যান থাকা অতিজরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করার বিষয়টি একেবারেই অমানবিক। জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারি সমিতির (ঢামেক শাখা) সভাপতি ও নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মো. রমিজের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। ফলে তার কোনো বক্তব্য মেলেনি।
এদিকে গতকাল বিকেলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানকে ফোন করা হলেও তার কোনো সাড়া মেলেনি। তবে তিনি ক্ষুদে বার্তায় বলেছেন ‘আমি কিছুক্ষণ পর কলব্যাক করছি’। কিন্তু পরবর্তীতে তার কোনো বক্তব্য বা সাড়া পাওয়া যায়নি।