মোঃ সাইফুল ইসলামঃ
প্রবাহমান তাপদাহ স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। প্রকৃতির এমন একটানা বৈরী আচরণ অভাবনীয়। কেবল দিবাভাগে নয়, অহর্নিশি অস্বস্তিকর প্রহর কাটাচ্ছেন মানুষ। সাথে প্রাণীকুলও। এমনকি কাছ-পালা-বৃক্ষলতা, ফল-ফসল, পরিবেশ-প্রতিবেশ সমস্ত কিছু। হাঁফিয়ে উঠেছে দেশ। প্রাণঘাতী এই অসহ্য গরমে সবাই চাতকের মতো তুমুল বৃষ্টির জন্য অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। উন্মুক্ত প্রান্তরে সালাতুল ইসতেস্কা পড়ছেন মুসলমানরা। সিলেটসহ কিছু স্থানে বিক্ষিপ্ত যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে পথের ধুলোর মরণ হলেও মোটেই স্বস্তি মিলছে না।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন,টানা ভারি বর্ষণ ছাড়া এই দাবদাহ পরিস্থিতির নিকেশ নেই। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় তাপমাত্রা আবারো বেড়েছে। ঈশ্বরদী, যশোর, চূয়াডাঙ্গা,খুলনা,রাজশাহী, মংলা, খেপুপাড়া মিলে ৭ জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে ছিল। ৪১ জেলার তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাপমাত্রার পারদ এমন থাকলে বাতাসে জলীয় বাস্পের আধিক্যের কারণে গরমের অনুভূত তাপমাত্রা অনেক বেশী দাহ্য। আবহাওয়া বিশ্লেষকরা বলছেন,তাপমাত্রা আজও চড়বে। সহসা নিস্তার মিলবে এমন আভাস দেশী-বিদেশী কোন আবহাওয়া মডেল দিতে পারছে না।
এই তাপদাহ দিনে দিনে প্রাণ সংহারের মাত্রা কেবল বাড়চ্ছে। হিট স্ট্রোকে প্রতিদিন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়ছে। গতকাল একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে হিট স্ট্রোকে। গত ২০ এপ্রিল থেকে গতকাল মঙ্গলবার অব্দি ৪ দিনে সারাদেশে হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন ৩৩ জনের বেশী। এদের মধ্যে ২০ এপ্রিল ৪ জন,২১ এপ্রিল ১১ জন,২২ এপ্রিল ৯ জন। গতকাল মঙ্গলবারও ৯ জন মারা গেছে।এদের বেশীরভাগই কৃষক। গতকাল পটুয়াখালীর বাউফলে হিট স্ট্রোকে মোহাম্মদ শাহ-আলম (৫০) নামের এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তিনি পুলিশের ঢাকা গোয়েন্দা শাখায় ডিবিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বাউফলে আসেন। সোমবার রাত ৯ টায় হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাউফল হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে তাকে বরিশালে পাঠানো হয়? বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে কৃষক আফসার আলী এবং মো. হাসান আলী ( ৪৩) হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন। নাটোর বড়াইগ্রামে বকুল হোসেন এক কৃষক,জামালপুরে মরিচ ব্যবসায়ী গোলাম রাব্বানী,বরগুনার আমতলীতে অজিতুন নেসা, কুমিল্লার বুড়িচংয়ে শ্রমিক মুজিবুর রহমান,খুলনার আড়ংঘাটায় ৬০ বছরের অজ্ঞাত এক জন, রাজধানীর গুলিস্তান টোল প্লাজার পাশের রাস্তায় মো. আলমগীর শিকদার (৪৫) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে হিট স্ট্রোকে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আলমগীর যাত্রাবাড়ির পশ্চিম শেখদি এলাকার মৃত জমির শিকদারের ছেলে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৪ নির্দেশনা:-
এদিকে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল ৪ নির্দেশনা জারি করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।এতে বলা হয়েছে, দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বিদ্যমান আছে। এ অবস্থায় সুস্থ থাকতে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
নির্দেশনাগুলো হলো:-
১. তীব্র গরম থেকে দূরে থাকুন, মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিন।
২. প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করুন। হেপাটাইটিস এ, ই, ডায়রিয়াসহ প্রাণঘাতি পানিবাহী রোগ থেকে বাঁচতে রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করুন।
৩. গরম আবহাওয়ায় ঢিলেঢালা পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরুন, সম্ভব হলে গাড় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলুন।
৪. গরম আবহাওয়ায় যদি ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, বমি বমি ভাব দেখা দেয়, তীব্র মাথাব্যথা হয়, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে হাসপাতালে যান এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ফের ঢাকায় বেড়েছে তাপমাত্রা:-
পরপর দুই দিন তাপমাত্রা খানিকটা হ্রাস পাওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আবার বৃদ্ধি পায়। আজ বুধবার আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক। তিনি জানান,গতকাল রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগামী তিনদিন তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই অবস্থা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।চলতি এপ্রিল মাসের বাকি সময়টা তাপপ্রবাহ থাকতে পারে। গত শনিবার রাজধানীর তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিও ছিল এ বছরে রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তবে রোববার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর তাপমাত্রা ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। ওই দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সোমবার ঢাকার তাপমাত্রা আরও কমে হয়েছে ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশের কোথাও কোথাও আগামী ২৪ ঘণ্টায় বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও আগামী এক সপ্তাহে পুরো দেশে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
মে মাসে বৃষ্টি হতে পারে:-
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান,এপ্রিলে তাপদাহ কমছে না। বৃষ্টির সম্ভাবনাও নেই। মে মাসের শুরুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হতে পারে। তখন তাপমাত্রা কমে আসতে পারে।
রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সালাতুল ইসতিস্কা-
এই চলমান তাপদাহ থেকে পরিত্রাণ পেতে বৃষ্টির জন্য রাজধানীসহ দেশের বহু এলাকায় সালাতুল ইসতিস্কা বা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ আদায় করেন। প্রখর রোদ আর গরমের মধ্যে খোলা মাঠে দাড়িয়ে কায়মনো ইসতেগফার করে আল্লাহর কাছে চোখের পানিতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিরা ফরিয়াদ করছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর আফতাবনগর ঈদগাহ মাঠে সালাতুল ইসতিসকায় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ ইমামতি করেন। এতে অংশ নেন শতাধিক মুসল্লি। নামাজ শেষে খুতবা এবং দোয়া করেন শায়খ আহমাদুল্লাহ। দোয়ায় প্রাকৃতিক দুর্ভোগ থেকে দুক্তিসহ দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করা হয়। এ সময় অনাবৃষ্টি এবং অসহ্য গরম থেকে মুক্তি ও মহান আল্লাহর রহমত কামনা করা হয়।
দোয়া শেষে শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, বনায়ন ধ্বংসের কারণে প্রতিবছর তাপমাত্রা বাড়ছে। এখনই সচেতন না হলে সামনের দিনে আরও বিপদে পড়তে হবে। সবুজায়ন বাড়াতে সবাইকে গাছ লাগানোর আহ্বানও জানান তিনি।
শায়খ আহমাদুল্লাহ এক পেস্টে জানান, তীব্র তাপদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। ওষ্ঠাগত মানুষ ও পশুপাখির প্রাণ। হুমকির মুখে ফল ও ফসল। এ সময়ে প্রয়োজন রহমতের বৃষ্টি। প্রিয়নবী (সা.) এমন অনাবৃষ্টিতে লোকদেরকে নিয়ে মাঠে বেরিয়ে যেতেন এবং ইসতিসকা তথা বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত আদায় করতেন। (বুখারি, মুসলিম)।আমরা দেশের সকল ইমাম-খতিব ও দায়িত্বশীলদের প্রতি সালাতুল ইসতিসকার সুন্নাহ জিন্দা করার বিনীত আহ্বান জানাই।
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও খুলনার শহীদ হাদিস পার্ক, রাজশাহী, চূয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, পিরোজপুর,লালমনিরহাট,নাটোরের লালপুর,বরগুনা পাথরঘাটাসহ বহুস্থানে সালাতুল ইসতিসকার খবর পাওয়া গেছে।