তিনটি কবিতা

প্রকাশিত: ১২:১২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০২৪

নাজনীন হক মিমি:

জল্লাদখানা
(১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদদের স্মরণে)
আমি এক জল্লাদ শত বছর
ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি, তোমার টুঁটি
চেপে-ধরার জন্য, আমার কোনো
বিবেক নাই, জানি না বিচার
আমি শুধু শূলের দড়ি ধরে টানি।
কেন তোমাকে ওরা হত্যা
করেছে, পিতামহ জানত না
কালো মুখোশ পরা মাথা, নির্ভীক
তোমার দৃঢ়তা, তোমার বলিষ্ঠ কণ্ঠ।
তোমরা কে, কারা কারা?
আজ আমি বিহ্বল, তোমার রক্তাক্ত
শরীর, শিকলে বাঁধা হাত-পা, আমি
বিচলিত তোমার উন্নত গ্রীবার কাছে,
তোমার শাণিত দৃষ্টি, আমার হাত কম্পিত
কে তুমি? শূলে দাঁড়িয়ে নির্ভীক
তিন পুরুষের জল্লাদ আমি, পিতামহের
আজ্ঞা, একটানে কবজির শক্তি প্রকাশ,
আজ বুকের ভেতর ঝড়, এমন মৃত্যু ভয়হীন প্রাণ
চারদিকে কিসের গুঞ্জন, মাথার ভেতর হাতুড়ি
পিটাচ্ছে তুমি জল্লাদ, তুমি জল্লাদ
ঢং ঢং তীব্র শব্দে ঘণ্টা বেজে ওঠে
আমার পা কাঁপছে, চোখ অবশ,
মন কি যেন শুনছে, আঁধারে এত আলো,
তোমার মুখোশ–ঢাকা চোখ থেকে এত আগুন
বাতাসের গুঞ্জন ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনিত
আমার তিন পুরুষের হাত অবশ,
অসহায় মন খোঁজে মা ও মাটিকে
বসে পড়ি লজ্জায় শুকনো দূর্বার কাছে
মন ও মাথায় কড়া নাড়ে একটি শব্দ
স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।

রাজপথ
কতবার হেঁটেছি এই পথে
আমরা যারা এই পথটা দেখেছি
এখানে মাটি ছিল না, সবুজ জলের পাশে
নাব্য ভূমি, জল-জঙ্গলে একাকার, মাছরাঙার
উড়ে যাওয়া, পড়ন্ত দুপুরে এক পায়ে সাদা বক,
আমরা যারা সময়টাকে দেখেছি
নিরিবিলি একান্তে, ধীর জীবনের বিকেলের
আলোতে, পাখিদের পাখ-পাখালিতে ভরে ছিল
জলের পাশ, প্রকৃতির ঋতু বদলের সুস্পষ্ট খেলা,
জলের ওপর বৃষ্টি ভেসে যায়, মাছেদের বুদ্‌বুদ জলের খেলা।
আমরা যারা যুদ্ধদিনের বিষণ্ন ভোর দেখেছি
সময়টা ছিল গুমোট অন্ধকার, এই পথে খালে
জলের ধারায় অন্ধকার ভোরে হয়েছে খেয়া পারাপার,
মানুষ খুঁজছে নিরাপদ আশ্রয়, উপশহর থেকে গ্রামে,
যুদ্ধ শেষে জলের ধারে খুঁজে পায় কিশোর বুলেটের খোসা।
আমরা যারা এ পথটাকে দেখছি
নারীর খসে-পরা আঁচলের মতো জলের ধারা,
কচুরিপানা ঠেলে যাওয়া আপনমনে কোনো যুবকের বৈঠা,
সময়টা ছিল শব্দহীন সন্ধ্যা, ঝিঁঝি পোকার ডাক, জোনাকির আলো।
কত দিন পরে আমরা আজ এ পথটা দেখছি
সময়ের হিসাব নেই, মহাকাশের পথে মানুষ,
হারিয়েছে পৃথিবী লাবণ্য, শহর বেড়েছে জলের ওপর
গোধূলির আলো ছাপিয়ে, অন্ধ দেখে আলোর বিচ্ছুরণ,
নরম পায়ে মসৃণ রাজপথে রাখি পা, আবার যদি খুঁজে পাই
মাটির নিচে জলের ধারা।

শালিক
তুমি কি আধুনিক, উঁচুতলার সানশেডে
আজকাল বসে থাকো, তুমিও ক্যাফেতে যাবে,
এত জোরে ডাকছ কেন, আমার আধুনিক
বাদ্যযন্ত্র ছাপিয়ে তোমার আর্তচিৎকার!
একি চারদিকে শহরের কোলাহল, নাম না-জানা
ছাত্ররা রাজপথে অবরোধে স্লোগান স্লোগানে মুখর,
বিজ্ঞাপনের আলো ছাপিয়ে চার চাকার আলো
বিদ্যুতের ঝিলিক লজ্জায়, ভুলেছে বজ্রপাত।
আহ্‌ আহ্‌ কেন ডাকছ তুমি শালিক,
মানুষের মা আর্তচিৎকার করে ওঠে তার শিশুর জন্য,
পুলিশের লাঠিতে ভেঙেছে পা, আহত ছাত্রের করুণ কান্না
আধুনিক শহরে চলবে না প্রতিবাদ, শালিক থামো—
উন্মাদিনী মার চিৎকারে, থেমে গেছে বিলাসবহুল গাড়ি
ছেলেটির মাথা কোলে নিয়ে বসছে মা রাজপথে,
ষোলো বছরের কাজের মেয়ে, সব ভয় ভেঙে উঠেছে কার্নিশে
পা-ভাঙা শালিক ছানাকে সস্নেহে নিয়েছে করতলে।