# ধরা-ছোঁয়ার বাইরে মূলহোতা অভি
# সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষায় পরিবার
এসএম দেলোয়ার হোসেন
দীর্ঘ ২২ বছরেও শেষ হয়নি দেশের বহুল আলোচিত মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যার বিচার। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এ নিয়ে নিহতের পরিবার এখনও সুষ্ঠু বিচারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, খুব শিগগিরই মামলাটির বিচারকার্য শেষ হবে এবং ভিকটিম ন্যায় বিচার পাবেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী ১১ ফেব্রæয়ারি যুক্তিতর্কের জন্য তারিখ ধার্য রয়েছে।
নিহতের পরিবার অভিযোগ করেন, তিন্নি হত্যাকাণ্ডের পর তাদের পরিবার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সে সময় তিন্নির একমাত্র কন্যা সন্তানের বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। মায়ের এমন নির্মম মৃত্যুর ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার দেখার আশায় বুক বেঁধে আছেন তিন্নির ২৩ বছরের তরুণী কন্যা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে মডেল তিন্নির লাশ পাওয়া যায়। পরদিন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) মো. শফিউদ্দিন। মামলাটি দায়েরের প্রায় ২২ বছর পার হলেও এখনও বিচার শেষ হয়নি।
নিহত তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম নিউজ পোস্টকে বলেন, মামলাটি একবার রায়ের পর্যায়ে চলে এসেছিল। কিন্ত এ মামলায় আমার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি। ওই সময় বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আবারও সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে চলে আসে। এখন শুনেছি যুক্তিতর্কে এসেছে। তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ের মধ্যে তিন্নি সবার বড় ছিল। তাকে নির্মম খুন করেছে অভি। ছোট মেয়ে কাছে নেই। এখন আমি বড় একা হয়ে গেছি। ২২ বছর ধরে অপেক্ষা করছি মেয়ে তিন্নির খুনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার পাব? নাকি তা ঝুলে যাবে। মাহবুব করিম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, মেয়ে তিন্নির সুষ্ঠু বিচার না পেলে বেঁচে থেকে আর কী লাভ! আল্লাহর কাছে বিচার ছেড়ে দিয়েছি, তিনিই একদিন এর সঠিক বিচার করবেন। তিনি বলেন, আসামি অভি অনেক প্রভাবশালী। সে সময় তাকে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনেছি এখনও মাঝে মধ্যে মেয়ে তিন্নি হত্যার আসামি দেশে আসে, আবার চলেও যায়।
তিন্নির বাবা বলেন, এ মামলার আসামির সাজা হলেও লাভ কী? তাকে তো আর কেউ ধরবে না। সাজাও কার্যকর হবে না। মনে হয় মেয়ে হারানোর কষ্ট নিয়েই আমাকে মরতে হবে। ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে হয়তো এই পৃথিবীতে আসামির বিচার হবে না। তবে আল্লাহর কাঠগড়ায় একদিন তার বিচার হবেই হবে। হয়তো তিন্নির পরিবারকে সেদিনের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মিজানুর রহমান সজল নিউজ পোস্টকে বলেন, ঠিকমতো সাক্ষী আদালতে না আসায় মামলাটির বিচারকার্য শেষ হতে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া রায়ের পর্যায়ে এসেও নতুন করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আরও বিলম্বিত হয়। সব মিলিয়ে মামলাটি প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। আশা করি খুব শিগগিরই এই মামলার রায় ঘোষণা হবে।
তিনি বলেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসামির সর্বোচ্চ সাজাও দাবি করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারি পাবলিক প্রসিকিউটর ভোলা নাথ দত্ত বলেন, আলোচিত মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার জন্য ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর তারিখ ঠিক ছিল। কিন্ত সেদিন মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দিতে চাইলে আদালত রায় মুলতবি করে সাক্ষ্যগ্রহণে চলে যান। তিন্নির বাবা ও চাচাসহ অন্যান্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলাটি এখন যুক্তিতর্ক পর্যায়ে চলে এসেছে। আশা করি, এই মামলায় খুব শিগগিরই যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা করবেন বিজ্ঞ আদালত।
এদিকে পলাতক আসামি (অভি) পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মামলায় যা ছিলঃ
মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদীর ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে মডেল তিন্নির লাশ পাওয়া যায়। পরদিন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার তৎকালীন সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) মো. শফিউদ্দিন। এতে নিহতের শরীরের বিভিন্ন স্থান থেঁতলানো। মাথার সামনে গুরুতর জখম। ১৫ নভেম্বর একটি জাতীয় পত্রিকায় বেওয়ারিশ মরদেহের ছবি প্রকাশ করে পুলিশ। ছবি প্রকাশের পর তিন্নির স্বজনরা মরদেহটি তিন্নির বলে শনাক্ত করেন। যদিও এর আগেই সুরতহাল রিপোর্ট ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে দিয়ে জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয় তিন্নিকে। আর ১১ নভেম্বর রাজধানীর কেরাণীগঞ্জ থানায় তদন্তকালীন সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) মো. শফিউদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। পরে ২০০২ সালের ২৪ নভেম্বর তদন্তভার সিআইডিতে ন্যস্ত হয়।
এদিকে সুপরিচিত মডেল তারকা তিন্নির মরদেহ শনাক্তের পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। পরে পুলিশ তিন্নির স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়াল, এবায়দুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী ও গাজী শরিফ উল্লাহ ওরফে তপন গাজীকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখনও প্রধান আসামি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পরে পুলিশ আটঘাট বেঁধে তদন্ত শুরু করে। এরপরই নিত্য নতুন তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। তদন্তের একপর্যায়ে পুলিশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির নাম। জিজ্ঞাসাবাদে ইমন পুলিশকে জানান, তিনি যখন ভারতে পালিয়ে ছিলেন, তখন অভির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। সে সময় অভি কথা প্রসঙ্গে বলেন, মডেল তারকা তিন্নির সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা ও প্রেমের সম্পর্ক হয়। তিন্নিকে দিয়ে তার স্বামী পিয়ালকে ডিভোর্স দেওয়ান এবং তিন্নিকে বিয়ের আশ্বাস দেন অভি। এমনকি বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তিন্নির সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন ও তিন্নির বাসায় রাত্রিযাপন করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে ইমন পুলিশকে আরও জানান, তাগিদ দিয়েও বিয়ে না করায় অভির গোপন তথ্য মিডিয়াতে ফাঁসের হুমকি দেন তিন্নি। হত্যাকাণ্ডের দিন এমন হুমকিতে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। একপর্যায়ে অভি তিন্নির মাথা ধরে ধাক্কা দেন। এতে তিন্নি আঘাত পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে পরে অভি তার গাড়িতে করে তিন্নির মরদেহ বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে রাখেন। এরপর ভারতে পালিয়ে যান। ইমনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিন্নি হত্যাকাণ্ডের মোড় ঘুরতে থাকে। এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হক। দীর্ঘ সময় পর ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর তদন্তকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোজাম্মেল হক ঢাকার সিএমএম আদালতে আলোচিত এ মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা তিন্নির স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়াল, এবায়দুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী, গাজী শরিফ উল্লাহ ওরফে তপন গাজীকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন। অপরদিকে প্রধান আসামি সাবেক ছাত্রনেতা ও সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তবে মামলার আসামি শুরু থেকে পলাতক রয়েছে। ২০১০ সালের ১৪ জুলাই অভির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। এ ছাড়াও এই মামলায় ২২টি আলামত জব্দ করা হয়।