দেশজুড়ে একযোগে সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর আজ: এখনও শেষ হয়নি বিচার

প্রকাশিত: ৩:৩৬ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
দেশজুড়ে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একযোগে সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর আজ বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট)। ২০০৫ সালের এই দিনে কেবলমাত্র মুন্সিগঞ্জ জেলা ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জেএমবি’র জঙ্গিরা। এতে হতাহতের ঘটনায় মামলা হলেও এখনও শেষ হয়নি ন্যাক্কারজনক এসব হামলা মামলার বিচার। অপরদিকে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এতো তৎপরতার পরও দেশ থেকে জঙ্গি হামলার আতঙ্ক কাটেনি। মাঝে মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে ভয়ঙ্কর জঙ্গি সদস্য। এরই মধ্যে গত বছরের শেষের দিকে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নামে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারের পর গত ৯ আগস্ট এই জঙ্গি সংগঠনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরই মধ্যে গত ১৩ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পাহাড়ে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে আরেকটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে সিটিটিসি। ইমাম মাহমুদের কাফেলার প্রধান নেতাসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে অনলাইন মাধ্যমে জঙ্গিরা তাদের প্রচারণা ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনলাইনেই তারা জঙ্গি হামলার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা হামলার কৌশল রপ্ত করছে।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলার (মুন্সীগঞ্জ বাদে) ৪৩৪ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯ টি মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় ৬৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শেষে এসব মামলায় ৭৩৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। হামলার ১৮ বছরের মধ্যে ১১৬টি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। ৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ৩২২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত। গ্রেফতারকৃত আসামির মধ্যে ৩৫৮ জনকে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড রায় দেয়া হয়েছে ১৫ জনকে।
ঢাকা মহানগর আদালত সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর এলাকায় বোমা হামলার ঘটনায় ওই সময় ১৮টি মামলা দায়ের হয়। এই ১৮টি মামলায় পুলিশ ও র‌্যাব ৯১ জনকে গ্রেফতার করে। ৫৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দেয়। অনেক মামলায় আসামিদের নাম ও ঠিকানা কিছুই নেই বা ছিল না। সাক্ষীদেরও ঠিকমত পাওয়া যায়নি। অনেক সাক্ষী সাক্ষ্য দিতেও আসেননি। বেশিরভাগ সাক্ষীর ঠিকানাও পরির্বতন হয়েছে। এ কারণে ১৪টি মামলায় মাত্র ৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত। বাকি ৪টি মামলা বিচারাধীন পর্যায়ে রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ঢাকার আদালতে ১৮টি মামলা ছিল। বর্তমানে ৪টি মামলা বিচারাধীন আছে। সেগুলোও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। মামলার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাক্ষীদের অনুপস্থিতিই মূল কারণ। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীদের পাওয়া যায়নি। সাক্ষীদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। পুলিশও চেষ্টা করছে সাক্ষীদের খুঁজে বের করতে। চাঞ্চল্যকর এসব মামলা চাইলেই তো শেষ করে দেওয়া যায় না। তারপরও সাক্ষী যা হয়েছে, বা আরও কয়েকটা সাক্ষী নিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে এ বছরের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করার চিন্তাভাবনা আছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাবের অভিযানেই জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ্, আবদুল আউয়াল, আসাদুল ইসলাম আরিফসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতারা গ্রেপ্তার হয়। তাদের বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছে। তাদের ফাঁসির রায়ও সরকার কার্যকর করেছে। জঙ্গিরা এখন সাইবার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালানোর চেস্টা করছে। জাতিগতভাবে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদকে পছন্দ করে না। একারণে আমরা খুব অল্প সময়ে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রনে আনতে সক্ষম হয়েছি। জঙ্গি কার্যক্রম থেকে ফিরিয়ে এনে তাদেরকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাই বলে এটা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। তবে অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সমন্বয় করে জঙ্গিদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। আমরা সাইবার ওয়ার্ল্ডে খোঁজ খবর ও নজরদারি করছি। এটা নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।

 

প্রসঙ্গত, ২০০০ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে বোমা হামলার মধ্যদিয়ে জেএমবি’র কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণ, রাজশাহীতে প্রকাশ্যে জঙ্গি কার্যক্রম, গাজীপুরে আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলা, ঝালকাঠিতে বিচারকদের ওপর বোমা হামলা, নেত্রকোনায় উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ ২০০৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে আলোচনা বিষয় স্থান করে নেয় জেএমবি’র জঙ্গি কার্যক্রম। জেএমবি’র কার্যক্রম যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। জেএমবি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কার্যক্রম বিস্তার করার চেস্টা করছে। ইতিমধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের তথ্য মিলেছে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবি’র বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবস্থান জানান দেয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট ভারতের ব্যাঙ্গালুরু এলাকা থেকে জেএমবি’র দুর্ধর্ষ পলাতক জঙ্গি বোমারু মিজানকে গ্রেফতার করে ওই দেশের এনআইয়ে টিম। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল রাজধানীর গুলিস্তানে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলায় ৩ পুলিশ সদস্য আহত হয়। ওই বছরের ২৭ মে মালিবাগে পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলায় একজন পথচারী আহত হয়। একই বছরের ২৩ জুলাই রাতে খামারবাড়ী ও পল্টন পুলিশ বক্সে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা দুইটি শক্তিশালী আইইডি যুক্ত বোমা ফেলে রেখে যায়। চলতি বছরে বান্দরবানের পাহাড়ে জামায়াতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নামে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ বছর এটি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে আরেকটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হয়েছে।

এদিকে র‌্যাব-সিটিটিসিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গি দমনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বোচ্চ সতর্ক প্রহরায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সন্দেহভাজনদের উপর চলছ গোয়েন্দা নজরদারি। জঙ্গি নির্মূলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়  জঙ্গি গোষ্ঠীর নতুন আস্তানায় অভিযান অব্যাহত রেখেছে  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।