দ্রুত এগোচ্ছে ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ, বদলে যাবে ঢাকাবাসীর জীবনমান

প্রকাশিত: ৬:৫৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩

সেলিনা আক্তার:
নগরবাসীর সবচেয়ে বড় অস্বস্তি ও ভোগান্তির নাম যানজট। ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার এই যানজট থেকে রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে নির্মিত হচ্ছে ফ্লাইওভার। চালু হয়েছে মেট্রোরেল। নির্মাণ হচ্ছে পাতাল রেল। তবে ঢাকার মানুষের জন্য স্থায়ী সুখবর নিয়ে আসতে পাওে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। যেখানে একযোগে দুটি এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলমান। এর মধ্যে একটির একাংশ চালু হয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে বদলে যাবে ঢাকাবাসীর জীবনমান। নাগরিক জীবনে উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রুতসময়ে রপ্তানিপণ্য পরিবহনে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাড়বে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি। সৃষ্টি হবে নিত্যনতুন কর্মসংস্থান।


ঢাকার যানজট নিরসনে সম্প্রতি বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা ঢাকা উড়াল সড়কের একাংশ যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের এ উড়াল সড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উড়াল সড়কটি বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। যেখানে প্রথম পর্বে চালু হয়েছে ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ। তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাঙ্খিত সুফল পেতে এখন ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে চোখ সরকারের। এ কারণে সব বাধা কাটিয়ে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে এ প্রকল্পের কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ছাড়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুফল মিলবে না। কারণ নির্মাণাধীন ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি বিমানবন্দরের কাওলা প্রান্তে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে মিলিত হবে। সেটি হলে সাভার, ইপিজেড সংলগ্ন শিল্পাঞ্চল ও ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে সরাসরি সংযুক্ত হবে। তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রপ্তানিপণ্য পরিবহন অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হবে।


বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, এ দুটি প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হলে এসব অঞ্চলে রপ্তানিযোগ্য পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসবে। সময়ের পাশাপাশি পরিবহন খরচও হবে সাশ্রয়ী। উন্নত ও দ্রুততর যোগাযোগ ব্যবস্থা সাভার শিল্পাঞ্চলে নতুন নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। এতে প্রচুর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি সাভার, আশুলিয়া, নবীনগর ও ইপিজেড সংলগ্ন এলাকার যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, যা সেসব এলাকার শিল্প বিকাশে আরও সহায়ক হবে। এ এক্সপ্রেসওয়েটি সাভার ইপিজেড থেকে আশুলিয়া-বাইপাল-আব্দুল্লাহপুর হয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাওলা প্রান্তে নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে দেশের ৩০ জেলার অন্তত ৪ কোটি মানুষ উপকৃত হবে।


বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি ৯ শতাংশ। পাঁচ হাজার পাইলের মধ্যে এক হাজার পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। তবে সব বাধা কাটিয়ে দ্রুত এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ। ২০২৬ সালের জুন নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ও পরিবেশ রক্ষায় দিনের বেলায় রাজধানীতে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপভ্যানসহ পণ্যবাহী ভারী যানবাহন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বলা হয়েছিল, সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পণ্যবাহী যানবাহন রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে না। ২০১৪ সালে এ বিষয়ে সবশেষ নির্দেশনাটি দেয় ডিএমপি। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে মামলা, রেকারিং, ডাম্পিংয়ের মতো ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বর্তমানে দিনের যে কোনো সময়ই রাজধানীতে পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করছে। এতে নগরীর যানজট যেমন অসহনীয় হয়ে উঠছে, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। তবে এ দুটি এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হলে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকবে না বলে জানা গেছে।


ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়েটির মোট দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। অন্যদিকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। দুটি এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৪৩ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চল তথা সাভার, আশুলিয়া, নবীনগর ও ইপিজেড সংলগ্ন শিল্প এলাকার যানজট নিরসন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। যার ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বা ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে চীনা এক্সিম ব্যাংক।


ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২০টি এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৫ থেকে ৬টি জেলার মানুষ আশুলিয়া-নবীনগর-বাইপাইল হয়ে সহজে এবং দ্রুত ঢাকায় প্রবেশ করতে পারবে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জেলার আনুমানিক চার কোটি মানুষ এ প্রকল্পের সুবিধাভোগী হবে। এতে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ বাড়বে বলেও আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন খান নিউজ পোস্টকে বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এভাবে পরিকল্পনা করেই দুটি প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। এ দুটি এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হলে ইপিজেড থেকে সরাসরি পণ্যবাহী যানবাহন ঢাকার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাবে। এখন ঢাকার ভেতরে দিনে পণ্যবাহী যানবাহন চলে না। কিন্তু দুটি এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে এ নিষেধাজ্ঞাও থাকবে না। তখন ঢাকা শহরে কোনো ধরনের যানজট বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করেই পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করবে। এতে আমাদের রপ্তানি খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক নির্মাণকাজে কোনো সমস্যা নেই। সব বাধা কাটিয়ে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হওয়ার সময় নির্ধারণ ছিল। মেয়াদ চার বছর বাড়িয়ে এখন ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।


বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি নির্মিত হলে প্রকল্প এলাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে শিল্পোন্নয়ন এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি দ্রুততর হবে। দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা মোতাবেক এ প্রকল্প দেশের জিডিপিতে শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ প্রভাব ফেলবে। এক্সপ্রেসওয়েটি হবে সাভার ইপিজেড থেকে আশুলিয়া-বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর হয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ র‌্যাম্প থাকবে। উড়াল সড়কের উভয় পাশে চার লেনের ১৪ দশমিক ২৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হবে। নবীনগর ইন্টারসেকশনে থাকবে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক। প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন এলাকায় তিন কিলোমিটার সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনাও থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে। নির্মাণ-পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য প্রকল্পটির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। দুই দশমিক ৭২ কিলোমিটার সেতুসহ ১৮ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনারও কাজ হবে এ প্রকল্পের আওতায়।

সেতু বিভাগ জানায়, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে ঋণচুক্তি সই হয়। এরপর চায়না এক্সিম ব্যাংক থেকেও চুক্তিতে সই হয়। ভূমি অধিগ্রহণ কাজও সম্পন্ন হয়ে অবকাঠামো কাজ চলমান। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে অনুমোদিত মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ঋণ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল চীন। যার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। ২৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা খরচ বাড়ানোর ফলে এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১৭ হাজার ১৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তবে এক্ষেত্রে চীনের ঋণ বাড়ছে না। প্রকল্পটি অনুমোদনের প্রায় চার বছর পর গত ২৮ অক্টোবর সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে চীনের ওই ঋণচুক্তি সই হয়েছে। চুক্তির আওতায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা ঋণ দিতে রাজি হয় চীনা এক্সিম ব্যাংক। দেশটির পলিসি প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) আওতায় এ ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় ব্যাংকটি। ঘাটতি ঋণ ১ হাজার ২৮০ কোটি টাকাসহ বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় ২৬২ কোটি টাকাও সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হবে। প্রথমে সরকারি অংশে প্রকল্পে অর্থায়ন পাঁচ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ফলে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করবে সরকার।