ধস-মৃত্যুও সরাতে পারে না তাদের, কক্সবাজারে ঝুঁকিতে অর্ধলাখ মানুষ

প্রকাশিত: ৫:৪৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২৪

কক্সবাজার প্রতিনিধি:

মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় থাকায় সারাদেশে গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজও সারাদিন থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি হতে দেখা গেছে। টানা ভারী বৃষ্টিতে সারাদেশে পাহাড়ধসের প্রবল আশঙ্কাও রয়েছে। এই শঙ্কার মধ্যেও কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়-টিলায় ও তার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা প্রায় অর্ধলাখ বাসিন্দাদের সেখান থেকে সরানো যাচ্ছে না। পাহাড়-টিলা ধসে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনায়ও তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

অভিযোগ রয়েছে, অল্প টাকায় বসবাসের সুযোগ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ পাহাড়-টিলা ও তার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন। মাঝে-মধ্যে প্রশাসন মাইকিং করে উচ্ছেদ কিংবা তাদেরকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও সে কর্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

জানা গেছে, গত এক বছরে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ১২টি পাহাড়ে নির্মিত হয়েছে শতাধিক নতুন ঘর। আর সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে হাজারো মানুষ।

বর্ষায় বাড়ে তোড়জোড়

সারাবছর নীরব থাকলেও বর্ষা এলেই প্রশাসন পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু করে। এজন্য মাইকিংও করে থাকে স্থানীয় প্রশাসন।

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘টানা বর্ষায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রেগুলো খোলা রাখা হয়েছে। আমরা অতিঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের তালিকা তৈরি করছি। এরপর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এছাড়া নিরাপদ স্থানে চলে যেতে প্রতিদিন মাইকিং করা হচ্ছে।’

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও পৌর সভায় টানা ভারী বৃষ্টিতে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটতে পারে এমন ৩২টি পাহাড় ঝূঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় প্রায় সাত হাজার পরিবারের প্রায় অর্ধলাখের কাছাকাছি মানুষ বসবাস করছে।

ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো- ফকিরামুড়া, বৈদ্যোর ঘোনা, কুয়েত মসজিদ, পুরান পল্লান পাড়া, নাইট্যং পাড়া, বরইতলী, ঘুমতলী (বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে), মরিচ্য গুনা, পশ্চিম সিকদার, মুরা পাড়া, লেচুয়াপ্রাং, ভিলেজার পাড়া, পশ্চিম রঙ্গীখালী, গাজী পাড়া, আলীখালী, লম্বাবিল, রইক্ষ্যং, করাচী পাড়া, কতুবদিয়া পাড়া, আমতলী, দৈংগাকাটা, হরিখোলা, কেরুনতী, বালুখালী, চাকমারকোল, কম্বিনিয়া পাড়া, শিয়াইল্যামুরা, সাতঘরিয়া পাড়া, হাছইন্নাটেক, শামলাপুর পুরান পাড়া, বড় ডেইল, মাথা ভাঙ্গা জাহাজপুরা, মারিষবুনিয়া, বাইন্যা পাড়া।

পুরাতন পল্লান পাড়া পাহাড়ে বসবাসকারী মো. জোবাইর বলেন, ‘বর্ষায় নির্ঘুম রাত কাটে। অন্য সময় তেমন একটা ভয় কাজ করেনা। সরকার যদি আমাদের জন্য অন্য কোনো জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয় সেখানে চলে যাব। তাছাড়া প্রতি বছর বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।’

পাহাড়ের পাদদেশে বাস করা মরিয়ম খাতুন (৪০) বলেন, ‘টানা বৃষ্টি হলে অন্যত্রে চলে যায়, বৃষ্টি কমলে ঘরে ফিরে আসি। বর্ষার সময় এভাবে থাকতে হয়। অনেক সময় রাত জেগে থাকতে হয়। কি করার? বিকল্প তো কোনো রাস্তা (জমি) নেই। প্রশাসন থেকে যখনই সতর্ক করা হয় তখন অন্যত্রে চলে যায়। এছাড়া মাঝে মধ্যে বন্য হাতির তাণ্ডবও চলে এখানে। সরকার যদি আমাদেরকে স্থায়ীভাবে আবাসন তৈরি করে দেয়, আমরা খুবই উপকৃত হতাম।’

জানা গেছে, টেকনাফ উপজেলায় ২০১০ সালে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসে ৩৩ জন নিহত হন। উখিয়ায় ২০১০ ও ১২ সালে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী ১৫ জন নিহত হন। এছাড়া চলতি বছরের ১৯ জুন বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে ১০ নিহত হন।

কক্সবাজারের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলো নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলে এ সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। প্রশাসন কখনও পাহাড়ে বসতি স্থাপনের মূল হোতাদের চিহ্নিত করেনি। যারা বসতি স্থাপন করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়নি।’

এ ব্যাপারে বনবিভাগের টেকনাফ রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, আমার এলাকায় দেড় হাজার মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রবল বর্ষণে যাতে প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে তাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।