নিজেস্ব প্রতিবেদক:
চারদিকে ঝোপঝাড় আর আবর্জনার স্তূপ। বিষাক্ত সাপসহ বিভিন্ন প্রাণীর আনাগোনা। সারি সারি পরিত্যক্ত ভবন, মরিচা ধরা যন্ত্রপাতি। রংপুরের শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেডের এমনই ভূতুড়ে পরিস্থিতি। একসময় উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল এই চিনিকল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে সেই গৌরব এখন অতীত। শুধু শ্যামপুর নয়, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেডেরও একই হাল।
আশার কথা, রংপুরের শ্যামপুর ও দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকল ফের চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারি ঘোষণার পরও চিনিকল দুটি চালুর ব্যাপারে নেই কোনো তোড়জোড়। চিনিকল চালুর প্রক্রিয়া এখনও কাগজ-কলমে বন্দি। দুই মিলেই পরিত্যক্ত ভবন, ঝোপঝাড়ে ঢেকে থাকা মাঠ, মরিচা ধরা যন্ত্রপাতির কিছুই স্পর্শ পায়নি সংস্কারের। চাষিরা বলছেন, চিনিকল চালুর খবরে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কল চালু করতে
তো অন্তত কিছু প্রস্তুতির দরকার। সেটি আমরা দেখছি না।
শ্যামপুরের বন্ধ কারখানার গেটে লাল কালি দিয়ে ‘সুখবর’ লিখে একটি পোস্টার সাঁটানো। তাতে সরকারি সিদ্ধান্তের তথ্য জানিয়ে সুগার মিলস কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কৃষককে আখ রোপণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতি কুইন্টাল আখ ৫৮৭ থেকে ৬০০ টাকায় কেনার জন্য দামও নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত চিনিকল চত্বরের যে প্রস্তুতি, তাতে আখ রোপণের আহ্বান, দাম নির্ধারণকে বাগাড়ম্বরই মনে করছেন চাষিরা। তারা বলছেন, এ যেন ‘ধান নাই চাল নাই, আন্দিরাম মহাজন’!
শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো কারখানা ফের চালু করার আগে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলের ক্ষেত্রে এসবের কোনোটাই করা হয়নি। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পনা ছাড়া এই উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
গত ১৭ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে ছয়টি বন্ধ চিনিকল ফের চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে রংপুরের শ্যামপুর ও দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকল রয়েছে। নির্দেশনা অনুসারে, দ্বিতীয় পর্যায়ে চালু হবে পঞ্চগড় ও পাবনা চিনিকল এবং তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকল।
বহুমুখী চ্যালেঞ্জ
স্থানীয় কৃষক, ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, চিনিকল দুটি এ মুহূর্তে চালু করা হলে ঝুঁকির পাশাপাশি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। তাদের মতে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে মিলের ভবন ও যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে অকার্যকর। পুরোনো প্রযুক্তির বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা ছাড়া বন্ধ থাকা এসব চিনিকল কার্যকরভাবে চালানো কঠিন। নতুন করে কারখানা চালু করতে গেলে বড় বাজেটেরও প্রয়োজন। আগের শ্রমিক ও চাষির বকেয়া পরিশোধ এখনও হয়নি, যা নতুন আখ সরবরাহে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্থানীয় চাষির আস্থা হারানোর কারণে আখ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। নতুন করে চাষিকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী করাও বেশ চ্যালেঞ্জের।
এ ছাড়া কারখানা চালু করতে গেলে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন, যা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে হারিয়ে গেছে। এখন উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে শক্তিশালী বিতরণ নেটওয়ার্ক নেই। এ কারণে কারখানার উৎপাদিত চিনি বাজারজাত করা কঠিন হবে। সবকিছু ঠিক হলেও চিনিকলের উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করতেই দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। এতে করে প্রকল্পটি দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে চিনির আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে দেশীয় চিনির উৎপাদন খরচ কমানো প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদ ড. শিরিন আক্তার বলেন, চিনিকল ফের চালুর কারণে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। সরকারের উচিত আধুনিক ব্যবস্থাপনা সংযোজনের মাধ্যমে চিনিকল সচল করা।
ব্যবসায়ী নেতা সাইরুল ইসলাম বলেন, কারখানা চালুর আদেশ দেওয়া হলেও বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি নেই। অবকাঠামো সংস্কার বা আধুনিকায়নের কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। মিলগুলো চালুর জন্য নতুন করে যেসব যন্ত্রাংশ সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলোর বরাদ্দ মেলেনি।
শ্যামপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপক (হিসাব) ফজলে এলাহী বলেন, কারখানা চালুর সিদ্ধান্তের পর আগামী ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য জনবল, কারখানা মেরামত, মালপত্র কেনা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আস্থা সংকটে কৃষক
দীর্ঘদিন চিনিকল বন্ধ থাকায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত আখের সঠিক দাম পাননি। আখ সরবরাহের পরও দীর্ঘ সময় বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি, যা চাষিদের আখ চাষে নিরুৎসাহিত করেছে। মিঠাপুকুরের চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ধান, গম, ভুট্টা, সবজি ইত্যাদি তুলনামূলকভাবে লাভজনক এবং চাষের সময় কম লাগে। এসব
ফসলের বাজারজাতকরণ ও মুনাফা দ্রুত হয়, যা চাষিদের কাছে আকর্ষণীয়। আমি নিজেও আখ চাষ বাদ দিয়ে এখন অন্য ফসল করছি।’
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জের কৃষক মমিনুল হক বলেন, ‘আখের বাজারমূল্য কম থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে মিল চালু হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। এখন সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমের ব্যয় অনেক বেড়েছে। এসব কারণে আখ চাষে বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকারি ভর্তুকি বা সহজলভ্য ঋণ চাষিদের কাছে পর্যাপ্তভাবে পৌঁছে না। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের কারণে আখ চাষের জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
জানা গেছে, কৃষকরা এক সময় আখ চাষে মনোযোগী ছিলেন। তবে মিল বন্ধ হওয়ার পর অনেকে আখ চাষ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। আখ চাষে সময় লাগে প্রায় ১৭ মাস, যা কৃষকের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
চিনিকল যেভাবে বন্ধ
প্রায় ১২০ কোটি টাকার লোকসানে ডুবে ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যায় রংপুরের শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড। ওই সময় মিলের শ্রমিক ছিলেন ৭৮০ জন। একই সময়ে ৯৫ কোটি টাকা লোকসান গুনে বন্ধ হয় দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড। সেখানে শ্রমিক ছিলেন ৬৫০ জন। আর ৮০ কোটি টাকা লোকসান করে বন্ধ হয় পঞ্চগড় সুগার মিলস। এই মিলে শ্রমিক ছিলেন ৫৮০ জন। ১১০ কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে বন্ধ হয় পাবনা সুগার মিল। সেখানে শ্রমিক ছিলেন ৭২০ জন। ১০৫ কোটি টাকা লোকসান করে বন্ধ হয় কুষ্টিয়া সুগার মিল। এটির শ্রমিক ছিলেন ৬৯০ জন। ১১৫ কোটি টাকা লোকসান করে বন্ধ হয় রংপুর সুগার মিল। সেখানে শ্রমিক ছিলেন ৭৫০ জন।
প্রথম ধাপে চালুর তালিকায় থাকা সেতাবগঞ্জ মিলটি চার বছর ধরে বন্ধ। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে মিলের মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও অবকাঠামো নষ্ট হয়ে এখন ব্যবহার অনুপযোগী।
সেতাবগঞ্জ মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল বাশার জানান, আখ রোপণ ও কারখানার মেরামত কার্যক্রম একসঙ্গে শুরু হবে। পর্যাপ্ত আখ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে আগামী বছর কিংবা তার পরের বছর উৎপাদন শুরু সম্ভব হবে। তবে সরকারি ঘোষণার পর এখনও কোনো কাজ শুরু করা যায়নি।
ভুলে ভুলে অতীতে লোকসান
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলের লোকসানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। আশির দশকে চালু হওয়া মিল দুটি অব্যবস্থাপনার গ্যাঁড়াকলে পড়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছিল। শিল্পের কার্যক্রমে প্রশাসনিক ত্রুটি এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ছিল অন্যতম কারণ। চিনিকলের যন্ত্রপাতি ছিল পুরোনো, যা উৎপাদন কার্যক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যন্ত্রপাতি সংস্কারের অভাব এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ছিল, কমছিল কার্যকারিতা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করার ফলে খরচের চেয়ে উৎপাদন আয় খুবই কম ছিল। এসব কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জসহ ছয় চিনিকল বন্ধ করে দেয়। এতে করে হাজারো শ্রমিক এবং আখ চাষি তাদের কর্মসংস্থান ও ব্যবসার ক্ষেত্র হারান।
শ্যামপুর সুগার মিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান বলেন, ‘পরিকল্পনার বাস্তবায়ন যদি সঠিকভাবে না হয়, তাহলে সরকারের এ সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হতে পারে। আমরা চাই না, নতুন করে কোনো ঝুঁকি নিতে। অনেকে পেশা বদল করেছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের নানা প্রণোদনার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।’
সেতাবগঞ্জ চিনিকলের সাবেক শ্রমিক মফিজুল হক বলেন, ‘আমাদের বহুদিনের অপেক্ষা শেষ হতে যাচ্ছে। তবে আমরা চাই, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হোক। পুরোনো ধ্যানধারণা নিয়ে মিল চালু করা হলে আবারও লোকসানের বোঝা বাড়বে।’
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আকবর আলী বলেন, চিনিকল চালুর উদ্যোগ সরকারের সাহসী পদক্ষেপ। এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে।