মোঃ সাইফুল ইসলামঃ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে দুই প্রতিবেশীর বহুমাত্রিক সম্পর্ক। সম্পর্কের গভীরতা কতটা সেটা বোঝাতেই দেশের জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন চলাকালেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ঢাকা সফরে আসেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানাতে এসে তিনি দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরে তিস্তা, ভিসা, সীমান্ত সন্ত্রাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আলোচিত হয়। বহুমাত্রিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে যে ঢাকা ও দিল্লি অনেক বেশি যত্নশীল সেটাও বোঝা যায় তার সফরে।
ভারতের নির্বাচনপর্ব শেষ হলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাবেন। তার দিল্লি সফর উভয় দেশের সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে। ভারতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কোনও প্রভাব পড়ে না। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির সরকার গঠিত হলেও আমাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং গত ১০ বছরে আগের থেকে আরও ভালো হয়েছে বন্ধুত্ব।
তাই ভারতের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের বাংলাদেশ নিয়ে নীতিমালায় কোনও পরিবর্তনের সম্ভাবনা শূণ্য। ভোট চলাকালেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব উড়ে আসেন ঢাকায়। অবশ্য গত মাসেই তার আসার কথা ছিল। সেটা বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে যায়। তবে ভোট মরশুমেই বাংলাদেশ সফর করলেন তিনি।
কূটনৈতিক মহলের মতে, তার এই সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উদ্দেশ্য ছিল, জানুয়ারি মাসে ফের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো। তাই ঢাকা সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনি দিল্লির আমন্ত্রণ পত্রও তুলে দেন। এছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মাদক চোরাচালান উভয় দেশের কাছেই বড় সমস্যা। এবিষয়টি দুই দেশের মধ্যে সৌজন্য বৈঠকেও আলোচিত হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা প্রায়ই গুলি চালিয়ে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা করেন।
তবে বিএসএফ কর্মকর্তাদের পাল্টা দাবি, চোরাচালান রোধ করতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়লে নিজেদের জীবন বাঁচাতে গুলি চালাতে বাধ্য হন জওয়ানরা। অনেক সময় জওয়ানদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। তবে পরিসংখ্যান দিয়ে তাদের আরও দাবি, সীমান্তে গুলি চালনার ঘটনা অনেক কমেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে বৈঠকেও বিএসএফের গুলিচালনার ঘটনার প্রসঙ্গ ওঠে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন, তারা তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ইতিমধ্যেই এবিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। ড. হাছান মামুদও বলেছেন, ‘তাদের (ভারতের) আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। এটি নিয়ে দুই দেশের সরকারি ও রাজনৈতিক পর্যায়ে আন্তরিকতারও কোনো ঘাটতি নেই’।
সীমান্ত অপরাধের পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়া আরও সহজ করার বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিনয় মোহন কোয়াত্রা। ভারত বছরে ১৬ থেকে ১৭ লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা প্রদান করে। কিন্তু চাহিদা আরও বেশি। তাই বহুদিন ধরেই ভিসা পদ্ধতি আরও সহজ এবং দ্রুত করার দাবি উঠছে। এখন অনেকটা স্বাভাবিকও হয়েছে।
বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই জানান, ভারতই সর্বোচ্চ ভিসা প্রদান করে। কিন্তু তারপরেও ভিসা পেতে অনেক সময়ই অসুবিধায় পড়তে হয় বাংলাদেশিদের। ভিসার জন্য বহুদিন অপেক্ষাও করতে হয়। তাই সমস্যাটির সমাধানে উভয়ের মধ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনাও হয়।
ভারতের প্রতিশ্রুতি, বাংলাদেশ মিশনের সক্ষমতা আরও বাড়ানো হবে। বাড়ানো হবে লোকবলও। অনলাইনে মানুষ যাতে সহজে ভিসা পান সেই বিষয়টিও আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দিল্লি। ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে কথা বলে এবং দিল্লির আন্তরিকতায় ড. হাছান মাহমুদ যে খুশি, সেটা তার কথাতেই বোঝা যায়।
বিতর্কিত তিস্তা প্রকল্প নিয়েও আমাদের কথা হয়েছে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালোয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই বলেন, ‘তিস্তায় আমরা একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ভারত সেখানে অর্থায়ন করতে চায়। সহায়তা প্রস্তাব নিয়ে আজ আলোচনা হয়েছে। তিস্তায় যে প্রকল্পটি হবে, সেটি আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হবে। তাই আমাদের প্রয়োজন যেন পূরণ হয়, এটি ভারতকে বলা হয়েছে।’
ড. হাছান মাহমুদের মতে, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে’।
বাংলাদেশের উন্নয়নে সর্বতোভাবে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। নিজেদের দেশের নির্বাচন নিয়ে যতই উত্তেজনা থাকুক না কেন দিল্লিতে, তার তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে তার প্রভাব পড়তে দিতে নারাজ। আসলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কখনওই কোনও অভ্যন্তরীন রাজনীতির প্রভাব পড়েনি। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সর্বতোভাবে সাহায্য করেন তিনি।
সেইসময়েও ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও ইন্দিরা গান্ধীর পাশে ছিলেন। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনকালে বন্ধুত্ব গভীর হয়। কিন্তু বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী বা বর্তমানে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী চেয়ারে বসলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং ঐতিহাসিক সম্পর্ককে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট জায়গায় উন্নিত করেছেন মোদি।
ছিটমহল সমস্যার সমাধানও হয়েছে মোদি ক্ষমতায় আসার পর। তাই ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, মোদি ও হাসিনার আমলেই দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো হয়েছে। ভারতীয় কূটনীতিবিদরা নিশ্চিত, চলমান নির্বাচনের ফলাফল যাইহোক না কেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও ভালো হবে। কারণ ঐতিহাসিকভাবেই উভয় দেশের বন্ধুত্ব প্রমাণিত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই শুধু নয়, বৈশ্বিক মহামারীর সময়েও ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের দেশের চাহিদা তুঙ্গে থাকলেও বন্ধু দেশ বাংলাদেশকে করোনা-প্রতিষেধক পাঠাতে ভুল করেনি দিল্লি। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময়েও ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগকে সম্মান জানাতে ভুলেনি দিল্লি।
জবাবে বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার প্রথম সরকারি বিদেশ সফর শুরু করেন দিল্লি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আগামী মাসে দিল্লি যাচ্ছেন সরকারি সফরে। তার আগে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফর বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ভারত থেকে আমরা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাশাপাশি বিদ্যুৎও আমদানি করছি। এবার বাংলাদেশ নেপাল থেকেও বিদ্যুৎ আনতে চায়। ভারতের ওপর দিয়ে আমরা নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবো। এবিষয়েও পররাষ্ট্রমন্ত্রী-পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে আলোচনা হয়। প্রাথমিকভাবে ভারত সম্মতিও জানিয়েছে। নিজেদের দেশের চাহিদার কথা মাথায় রেখে অন্য দেশে রপ্তানি বন্ধ করলেও বাংলাদেশে কিন্তু পেঁয়াজ পাঠানো বন্ধ করেনি দিল্লি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুদিন আগেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে দিয়ে গেছেন। তাঁর পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা ছিল, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। তার সুযোগ্য কন্যা, দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগরে সরকার বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শে ভর করে এগিয়ে চলেছে।
অন্যদিকে, ভারতও চাইছে উভয় দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়নে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও কার্যকরী করে তুলতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য দিল্লি সফর সেই দিক থেকে সকলের জন্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।