নারীর অধিকার!

প্রকাশিত: ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ 

এই ২১ শতাব্দীতে এসেও গর্ভের কন্যাশিশু এবং মাকে নিরাপদ রাখার জন্য হাইকোর্টে আইন পাশ করতে হয় : ‘গর্ভাবস্থায় শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ করা যাবে না।’ শুধুই মেয়েশিশুর মা হওয়ার জন্য একজন মাকে শুনতে হয় কটু কথা। অথচ বিজ্ঞান বলে সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে তা সমপূর্ণই নির্ভর করে বাবার ওপর। পরিবারের সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের এই সমাজ-সংসার নারীদের এসব অবদান স্বীকার করতে অনাগ্রহী।

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে নারীর সাহসিকতা, সংগ্রামের পরিবর্তে শহিদের মা, বোন, স্ত্রী অথবা নারীর বীরাঙ্গনা পরিচয়কেই বড় করে তুলে ধরা হয়। এই বীরাঙ্গনা উপাধি সম্মানের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নজিরও কিছু কম নয়। হাত-পা হারানো যোদ্ধা যেখানে সমাজের বাহবা পেয়েছে, সম্ভ্রম হারানো নারী সেখানে হয়েছেন সমাজচ্যুত। শিশিরকণা, বীথিকা বিশ্বাস অসীম সাহসিকতায় পাকিস্তানি গানবোট উড়িয়ে দিলেও যুদ্ধ শেষে তাদের পরিবারই গ্রহণ করেনি। জর্জিয়া ব্রিজ ধ্বংসে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল কাঁকন বিবির। তিনি ২০টিরও বেশি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে রাজাকারের হাতে ধরা পড়েন। তার ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন—গরম লোহার রড দিয়ে ছিদ্র করা হয় দেহের নানা জায়গায়। সাতদিন পর পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু এই নারীর যোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে সময় লাগে ২৬ বছর।

একজন উচ্চশিক্ষিত নারী গৃহস্থালির কাজে আত্মনিয়োগ করলে তাকে শুনতে হয় : ‘এত ডিগ্রি নিয়ে কী হলো? সেই তো বাসনই মাজতে হচ্ছে।’ বাসন মাজা কি ছোট কাজ? উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধুই অর্থ উপার্জন? উচ্চশিক্ষা কি ব্যক্তির চিন্তা, জীবনাচরণে কোনোই প্রভাব ফেলছে না? কী অবলীলায় বলে দেওয়া হয়—কিছুই করেন না, গৃহিণী। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, মায়েদের ব্যস্ত থাকা গৃহস্থালি কাজের বার্ষিক মূল্য দশ লাখ কোটি টাকারও বেশি, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জিডিপির ৭৬ শতাংশের সমান। গবেষণা বলছে, পুরুষের চেয়ে নারীরা তিন গুণ বেশি মজুরি বিহীন কাজ করে। নারীর গৃহস্থালির কাজ, সন্তান পালনকে মূল্যহীন ভাবা হয়।

একজন কর্মজীবী নারীকে হরহামেশাই শুনতে হয় মেয়ে সংসারী নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে গাড়ি চাপা পড়ে মৃত্যু, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, ভবন ধসে মৃত্যু এমনকি হাঁটার পথে মাথায় ইট পড়ে মৃত্যুও আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। এসব দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো তাদের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারাচ্ছে অথবা কর্মক্ষম ব্যক্তিটি শয্যাশায়ী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ছে নারীর কাঁধে। একজন বিধবা বা ডিভোর্সি নারীর ভরণপোষণ দিতে পরিবারের অস্বীকৃতি জানানো স্বাভাবিক ঘটনা। তাই নারীদের স্বাবলম্বী বা স্বাবলম্বী হওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন।

মাটি তোলা, রাস্তা পরিষ্কার, ইট ভাঙার মতো শক্ত কাজে নিয়োজিত নারীদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভোগেন। এসব কর্মজীবী নারী সংসারের একটু উন্নতির আশায় সবকিছুই হাসিমুখে মেনে নেন। কিন্তু বাড়ির বাইরে এদের নিরাপত্তা এমনকি সামান্য একটু শৌচাগারের ব্যবস্থা করতেও আমাদের রাষ্ট্র ব্যর্থ। আমাদের চারপাশে অনেক সংগ্রামী নারী রয়েছেন যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে পরিবার বেঁচে থাকে। অথচ সমাজ এ কাজগুলোকে শুধুই নারীর দায়িত্ব মনে করে। তাদের প্রতি ভালোবাসা, একটু সহমর্মিতা বা সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

আমাদের মেয়েদের সচেতন হতে হবে, বাহ্যিক রূপকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের আত্মসম্মান, শিক্ষা, সক্ষমতা, প্রতিভাকে বিসর্জন দিয়ে না বসি। নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতি নিজের অধিকার এবং সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ করতে হবে। নারী গৃহস্থালি কাজের জন্য যে শ্রম দিচ্ছে সেটাকে মূল্যহীন মনে করার সঙ্গে নারীর অসম্মান, অনিশ্চয়তা, পরাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবারের একটু মানসিক সমর্থন, একটু সহযোগিতা একজন নারী ঘরের এবং বাইরের কাজ দুটোই স্বাচ্ছন্দ্য করতে পারেন।নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। নারী-পুরুষের ভেদাভেদে না জড়িয়ে একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেই যেন তার প্রাপ্য অধিকারটুকু পায়।