নিয়োগবঞ্চিত এনটিআরসিএর নিবন্ধিত শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ কী?

প্রকাশিত: ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ, মে ১৮, ২০২৪

আমির আসহাবঃ 

যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) যোগ্যতার সনদ প্রদান করা সত্ত্বেও শিক্ষক নিয়োগ ক্ষমতা ছিল ম্যানেজিং কমিটির হাতে। ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে, ২০১৫ সালে এনটিআরসিএ-কে নিয়োগ সুপারিশ অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। অনার্স-মাস্টার্স করা এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী এনটিআরসিএ-র নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে বিষয়ভিত্তিক ‘শিক্ষক নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছে। শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে, এখানে কোনো জটিলতা থাকার কথা না। কিন্তু কেন এনটিআরসিএ-র সব শর্তে উত্তীর্ণ তরুণ-তরুণী বারবার নিয়োগ বঞ্চিত? কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক সংকটে? আর কেনই-বা এনটিআরসিএ-র নামে হাজার হাজার মামলা-মোকদ্দমা?

এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আধুনিক সময়োপযোগী একটি শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিকে জটিল করে তুলেছে। সুতরাং এখন যা হচ্ছে সবই পরিকল্পনাহীন ও সমন্বয়হীনতার বহিঃপ্রকাশ। কেউ কেউ ৪০ নম্বর পেয়ে চাকরি করছে, কেউ ব্লক পোস্ট পেয়ে চাকরিতে যোগদান করছে, আবার অবৈধ সনদ দিয়েও চাকরি করছে। অথচ বৈধ সনদধারীরা অযোগ্য হচ্ছে। আবার নিয়োগ সুপারিশের নামে হাজার হাজার আবেদনের বিপরীতে এনটিআরসিএ হয়ে উঠেছে অর্থ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান! তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে যেসব পদে আবেদন নেওয়া হয়েছে, ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবার ঐ সব পদ শূন্য দেখিয়েছে। ৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে যেসব পদে আবেদনপত্র নেওয়া হয়েছে, ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবার ঐ সব পদ শূন্য দেখিয়ে আবেদন নেওয়া হচ্ছে।

‘এমপিও নীতিমালা ২০১৮’ অনুসারে নির্দিষ্ট বয়স (৩৫ বছর)-এর আগে যারা নিবন্ধন সনদ অর্জন করেছে তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা কেন অবৈধ নয়, তা আইন বিশ্লেষণকারীগণ সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। যদি আইনি বাধ্যবাধকতা থাকেও জাতীয় স্বার্থে তা পুনর্বিবেচনার এখনই সময়। শুধুমাত্র ১৬তম ও ১৭তম ব্যাচে উত্তীর্ণদের নিয়ে ৫ম গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন এনটিআরসিএ। ১৬তম ব্যাচে উত্তীর্ণ সাড়ে ১৮ হাজারের বেশির ভাগ ইতিমধ্যে চতুর্থ সার্কেলে সুপারিশপ্রাপ্ত, ১৭তম সাড়ে ২৩ হাজার নতুন উত্তীর্ণ। তাহলে ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধিত নিয়োগ বঞ্চিত চাকরি প্রত্যাশী সর্বোচ্চ হবে ত্রিশ হাজার। অথচ শূন্যপদ প্রায় ৯৭ হাজার। সিদ্ধান্তগত ও সিস্টেমজনিত ত্রুটির কারণেই পদ ফাঁকা থাকবে প্রায় ৭০ হাজার।

১২.৬.২০১৮ তারিখের আগে যারা (১-১২তম) নিবন্ধন সনদ লাভ করেছে তাদের ক্ষেত্রে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৩৯০০/২০১৯ রায় অনুযায়ী বয়সসীমা শিথিলযোগ্য। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি উল্লেখ করে এনটিআরসিএ আবেদন গ্রহণ করেন। এনটিআরসিএ-র করা রিভিউ খারিজ হয়েছে। সুতরাং আইনত ১-১২তমদের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকার কথা না। এছাড়াও এমপিও নীতিমালা প্রবর্তন পরবর্তীদের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে তা পরবর্তীদের জন্য প্রযোজ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। পদ্ধতিগত পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। তাই সম্মিলিত তালিকা করায় কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হয়, আবার কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণে সর্বনাশ হয়ে যায়। নম্বরভিত্তিক তালিকা করার কোনো পূব ঘোষণা ছিল না, ফলে পূর্বে যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১-১২তমদের একই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করায় তাদের নব্বই ভাগেরই অবস্থান থাকে তালিকার পিছনের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই সবার জন্য নিয়োগ সুপারিশের কোনো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগ ও মনমানসিকতা না থাকলে ১-১২তম ব্যাচ নিয়োগ বঞ্চিত থেকে যাবে। হয়েছেও ঠিক তাই।

এনটিআরসিএ-র নিবন্ধিত শিক্ষকেরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে বিষয়ভিত্তিক ‘শিক্ষক নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছেন। শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হবে, এখানে কোনো জটিলতা থাকার কথা না। শিক্ষক নিবন্ধন সনদ শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসবে না। অনার্স-মাস্টার্স, এমএড-বিএড করেও নামমাত্র পারিশ্রমিকে অনেকের বয়েছে ৫-১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা। এনটিআরসিএ-র সব শর্তে উত্তীর্ণদের কোনো নিয়োগের সুরাহা না করে গণিত ও বিজ্ঞান বিষয় শিক্ষক সংকট থাকার কারণে ডিপ্লোমাধারীদের বিএসসি-এর সমমর্যাদা দিয়ে শিক্ষক ঘাটতি পূরণ করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে (ব্যাচভিত্তিক) নিয়োগ প্রদান সময়ের অপেক্ষামাত্র। কেননা, এনটিআরসিএ-র ওয়েব সাইটে নিবন্ধিত সনদধারীর সংখ্যা ৬ লক্ষাধিক। অথচ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে স্কুল ও কলেজ পৃথকভাবে আবেদন পড়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার। এবং স্কুল-কলেজ মিলে (যেহেতু একজন ব্যক্তির একাধিক পদে চাকরি করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃত চাকরি প্রত্যাশীর সংখ্যা হিসেবে) আবেদন পড়েছিল ৮১ হাজার। বর্তমানে শূন্যপদ ৯৭ হাজার। নতুন যুক্ত ১৭তমতে সাড়ে ২৩ হাজার। সবাইকে একত্র করে স্ব-স্ব নীতিমালায় একটি মাত্র ই-আবেদন নিয়ে প্যানেল করে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। দ্ইু-একটা বিষয়ে সাময়িক সমস্যা হলেও জাতি সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে। অন্যথায় প্রচলিত গণবিজ্ঞপ্তিতে কৃত্রিম শিক্ষক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। জাল সনদে কেউ কেউ চাকরি করছে, সরকারি বেতনভাতা তুলছে, অথচ বৈধ নিবন্ধিত শিক্ষকেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। এতে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য তো পূরণ হচ্ছেই না, শিক্ষার বৈরী পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব এবং বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত চাকরি প্রত্যাশী।