নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে প্রবাসীর পরিবার থেকে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়

প্রকাশিত: ৭:৫০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
নবাবগঞ্জের দড়িকান্দা গ্রামের হতদরিদ্র মোসলেম মোল্লা (৩০)। জীবিকার তাগিদে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ২০১৬ সালে ইরাক পাড়ি জমান। ইরাকে অবস্থানকালে বাংলাদেশি কয়েকজন তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে ইমো অ্যাপের মাধ্যমে ভিডিওকল দিয়ে নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য দেখিয়ে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অন্যথায় মোসলেমকে হত্যা করা হবে বলে তার পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়। ছেলের নির্যাতনের ভিডিও সহ্য করতে না পেরে মোসলেমের মা খতেজা বেগম ১২টি বিকাশ নম্বরে ৬ লাখ টাকা দেন। ইরাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বাংলাদেশি যুবক মোসলেমকে নির্যাতন করে তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বরিশাল, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মাগুরা এবং খুলনা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এরা হলেন- রবিউল ঘরামী (২৪), মো. শামীম (২৫), শিরিন সুলতানা (৩৫), সাহনাজ আক্তার লিপি (৩৮), আলী হোসেন (৪৯), মোহাম্মদ ঘরামী (৫১), শাহিদা বেগম (৫২) ও মো. আকবর সরদার (৫৫)। আজ সোমবার (২৮ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই ঢাকা জেলার ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা।


তিনি বলেন, ২০১৬ সালে জীবিকার তাগিদে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ইরাক পাড়ি জমান হতদরিদ্র মোসলেম মোল্লা। ইরাকে অবস্থানকালে সেলিম মিয়া ও শামীমসহ আরো কয়েকজন মোসলেমকে কাজের কথা বলে তার বর্তমান কর্মস্থল থেকে অন্যত্র অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে ইমো অ্যাপের মাধ্যমে কল দিয়ে মোসলেম মোল্লার পরিবারের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে, অন্যথায় তাকে হত্যা করবে বলে হুমকিও দেয়। এ ঘটনার পর মা খতেজা বেগম তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য ধার দেনা করে নবাবগঞ্জ থানার পাড়াগ্রাম বাজার থেকে ১২টি বিকাশ নাম্বারে ৬ লাখ টাকা দেন। পরবর্তীতে আসামিরা ভুক্তভোগী যুবককে মুক্তি না দিয়ে আবারও তার মায়ের কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করে। এই ঘটনায় খতেজা বেগম বাদী হয়ে নবাবগঞ্জ থানায় মামলা করেন। পরবর্তীতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে পিবিআই ঢাকা জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে অভিযান পরিচালনা করে আসামিদের গ্রেফতার করে পিবিআই। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, ৬ অক্টোবর, ২০২২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি এবং ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট ও ২৩ আগস্ট বরিশাল, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মাগুরা এবং খুলনা থেকে গ্রেফতার হয় মুক্তিপণ আদায় চক্রের সঙ্গে জড়িত সক্রিয় আটজনকে।


পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা বলেন, ইরাকে অবস্থানকালে ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি সেলিম মিয়া নামের একজনের সঙ্গে ভুক্তভোগী মোসলেমের পরিচয় হয়। সেলিম মোসলেমকে ভালো বেতনের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে আসামি আনোয়ার, শাহনেওয়াজ, রুহুল আমিন, মনির, হাসিবুর ও সাব্বিরের হাতে তুলে দেয়। মোসলেমকে নিয়ে গিয়ে আসামিরা একটি আবদ্ধ রুমে আটকে রাখে এবং তার সঙ্গে থাকা ২ হাজার ডলার ও দেড় লাখ টাকা মূল্যের আইফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নির্যাতন করতে থাকে।


তিনি বলেন, তিন দিন ধরে নির্মম, বর্বর নির্যাতনের পর সেই নির্যাতনের দৃশ্য ইমো অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসী মোসলেম মোল্লার মা খতেজা বেগমকে দেখায় এবং মোট ১১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। নিরুপায় হয়ে মা খতেজা বেগম ছেলের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আসামিদের পাঠানো ১২টি বিকাশ নাম্বারে ২৬টি ট্রাঞ্জেকশনের মাধ্যমে মোট ছয় লাখ টাকা দেন। আসামি আনোয়ার, শাহনেওয়াজ, রুহুল আমিন, মনির, হাসিবুর ও সাব্বির ইরাকে অবস্থান করলেও দেশে তাদের পরিবারের সদস্যরা এই মুক্তিপণের টাকা বিভিন্ন বিকাশ এজেন্টের দোকান ও নিজেদের বিকাশ নাম্বার থেকে ক্যাশ আউট করে নেয়।


পিবিআই’র এই কর্মকর্তা আরও জানান, শাহনেওয়াজ অপহরণ চক্রের দলনেতা। গ্রেফতার ৮ জন আসামিকে আদালতে সোপর্দ করা হলে ৬ জন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে বলে জানতে পেরেছে পিবিআই। আলী হোসেন (৪৯), মোহাম্মদ ঘরামী (৫১) ও রবিউল ঘরামীর (২৪) বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা রয়েছে, মুন্সিগঞ্জের সদর থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা রয়েছে। এছাড়াও আসামি মো. আকবর সরদারের (৫৫) বিরুদ্ধে মাগুরার মহম্মদপুর থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা রয়েছে বলেও জানান পিবিআই ঢাকা জেলার ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা।