নির্যাতনে চাতাল শ্রমিকের মৃত্যুর ফলে ঈদের আনন্দের বদলে সামিউলের পরিবারে চলছে মাতম

প্রকাশিত: ১২:০১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৮, ২০২৪

জেলা প্রতিনিধি,ময়মনসিংহঃ 

চৈত্রের খরতাপে পুড়ছে মাজমতলি গ্রাম। লাল ধুলার পথটা সাপের মতো বয়ে চলেছে মরা বাড়ির দিকে। গ্রামে কেউ মারা গেলে তার বাড়িকে মরা বাড়িই বলে সবাই। রাস্তা ধরে বাড়িটির দিকে এগিয়ে যেতেই কানে ভেসে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ।

যেখান থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে, সেখানে গিয়ে দেখা গেল পুরোনো একটি ছাপরা ঘর। কঙ্কাল সার দুটি শিশু খাবারের জন্য মায়ের পায়ের কাছে কাঁদছে; কিন্তু ঘরে খাবার নেই। স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তাদের মা সাথী আক্তার (২৫)। স্বামীর ওপর অমানসিক নির্যাতনের কথা মনে করে মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠছেন তিনি। অথচ ক’দিন আগেও ভাঙা ঘরটায় আনন্দের সীমা ছিল না। কথা ছিল এ মাসের বেতন পেয়েই সন্তানদের ঈদের নতুন জামা, স্ত্রীর শাড়ি এবং শাশুড়ির জন্য কেনাকাটা করবেন তাঁর স্বামী সামিউল ইসলাম। কিন্তু বিধিবাম, পৈশাচিক নির্যাতনের বলি হয়েছেন এই চাতাল শ্রমিক। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে পরিবারটি। এখন শিশুসন্তান সোহান (৬), আব্দুল্লাহ (৪) ও বৃদ্ধ মা মালেকা বেগমকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সাথী।

অনেকটা অভিযোগের তীর ছুড়ে দিয়ে সাথী আক্তার বললেন, ‘কালাম সরকারের রাইস মিলে কাম (কাজ) করত আমার জামাই। আমার মায় রাইন্ধা (রান্না) দিত। বিষুদবার (বৃহস্পতিবার) আবু হানিফার ছেলে রাশিদুল আর মিস্ত্রি আইনাল আইসা কইলো মিলে জরুরি কাম আছে। এই কথা কইয়া আমার স্বামীরে ডাইকা নিয়া যায়, ইফতারডাও করতে দেয় নাই। পরে শনিবার সকালে শরীফ সরকার আমারে ফোন দিয়া মিলে যাইতে কয়। মিলে গিয়া দেখি আমার স্বামীরে হাত-পাও বাইন্ধা (বেঁধে) গুদামঘরে রেখে দিছে। আমার স্বামীরে ছাইড়া দেওনের লাইগা পায় ধরি, পরে দরজা আটকাইয়া আবারও রড দিয়া আমার স্বামীরে পিটায়। আমার স্বামী কইছিল আমারে বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেল তাইলেও মাইরো না…। আমার স্বামী বলছে, শরীফের নির্দেশে তারা সবাই মিলা মারছে।’

তিনি বলেন, ‘ম্যানেজারের কালকে ধরে নিয়ে গেছে। আসল আসামিদের অহনাও ধরে নাই। উচিত বিচার আমরা পাবো কিনা জানি না। আমি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ এসব বলতে বলতে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন সাথী আক্তার।নিহত চাতালশ্রমিক সামিউল ইসলামের বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলায়। ছোটবেলায় মা মারা গেলে অভাবের সংসার ছাড়েন তিনি। ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতে গিয়ে পরিচয় হয় সাথী আক্তারের সঙ্গে। বিয়ে করে প্রায় এক যুগ আগে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা ইউনিয়নের মাজমতলি গ্রামে শ্বশুর মমিন মণ্ডলের বাড়ি চলে আসেন। এখানে বাকতা মাজমতলি গ্রামের সরকার অটোরাইস মিলে চাতালশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সামিউল। একই মিলে শ্রমিকদের রান্নাবান্না করে দিতেন তাঁর শাশুড়ি মালেকা বেগম। গত ২৯ মার্চ চালকলে কাজ করতে গিয়ে বেতন-বোনাস চাওয়ায় বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সামিউল। ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর হাত-পা বেঁধে রাতভর নির্যাতন চালান চাতাল মালিক আবুল কালাম সরকারের ছেলে শরিফ মিয়াসহ কয়েকজন। পরে স্বজনরা উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। গত শনিবার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

নির্যাতনের ঘটনায় গত ৩ এপ্রিল ফুলবাড়িয়া থানায় মামলা করেন সাথী আক্তার। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন মিয়া বলেন, ‘বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো ঘটনা নয়, একটি ইয়ারফোন নিয়ে বিরোধে সামিউলকে মারধর করা হয়েছে।’এ মামলায় গত শনিবার চালকলের ম্যানেজার এনামুল হককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার আরও দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে প্রধান আসামি শরিফ মিয়াকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।