জেলা প্রতিনিধি, পঞ্চগড়
বহু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কিনোয়ার আবাদ হচ্ছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। পেরিলা ও চিয়াসিডের পর সুপার ফুড খ্যাত নতুন এ ফসলটি আবাদের মধ্য দিয়ে উত্তরের এ জেলায় বাড়ছে নতুন নতুন পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসলের আবাদ। ফসলটি আবাদ করছেন জেলার সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের চারোখুড়া গ্রামের চাষি অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আমিনুর রহমান।
আমিনুর রহমান দ্বিতীয়বারের মতো আবাদ করছেন কিনোয়া। এর আগে তিনি আরেক সুপার ফুড চিয়াসিড আবাদ করে আসছেন। নতুন এ ফসলটি আবাদে ইউটিউব দেখে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। প্রথম পর্যায়ে মাত্র ১ বিঘা জমিতে আবাদের পর পরের বছর পরিধি বাড়িয়ে ১২ বিঘা জমিতে আবাদ করেন। তবে স্থানীয়ভাবে ফসলটির পরিচিতি না থাকায় বাজারজাত নিয়ে চিন্তিত এ কৃষক।
চাষি আমিনুর রহমান বলেন, সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর কৃষি কাজে মনোযোগ দেই। কিনোয়া ফসলটি মূলত আমি ইউটিউব দেখে চাষে উদ্বুদ্ধ হই। প্রথম দিকে আবাদ করি এক বিঘা জমিতে। এতে প্রথম বছরেই ফলনে সফল হই। এবার আবাদ করেছি ১২ বিঘা জমিতে। ফসল কাটা হয়ে গেছে। মাড়াইয়ের কাজ চলছে। এ বছরও ফলন ভালো হয়েছে। বিঘায় ৬-৮ মণ আসে। ফসলটি সম্পর্কে আসলে অনেকে পরিচিত নয়। এটি বিভিন্ন সুপারশপে ও বড় বড় রেস্টুরেন্টে চলে। যদি এবার দামে ভালো পাই তাহলে আগামীতে জমি বাড়িয়ে আবাদ করব।
কিভাবে বিক্রি করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পাইকারদের মাধ্যমে কিনোয়া বিক্রি করছি না। অনলাইনে বিক্রি করছি। ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে প্রচার চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে আড়াই মণ বিক্রি করে ফেলেছি। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি কিনোয়া বিক্রি করছি ৬০০ টাকায়। যদিও এর চাহিদা অনুযায়ী দাম বেশি। গ্রাহক হিসেবে বিভিন্ন সুপারশপ ও রেস্টুরেন্টগুলো নিচ্ছে।
আমিনুর রহমান আরও বলেন, কিনোয়া একটি অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ফসল। এটাতে ভিটামিন-সি ব্যতীত সব ধরনের ভিটামিন বিদ্যমান। এটি চাষ পদ্ধতিও সহজ। খরচ একেবারেই কম। প্রতি বিঘায় ১৫-২০ হাজার টাকার মতো খরচ করে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। তবে বাজারজাত একটু কঠিন। স্থানীয় বাজারে বহু পুষ্টি সম্পন্ন ফসলটি অপরিচিত। তবে অনলাইনে এর ব্যাপক চাহিদা আছে। আশা করছি লাভবান হব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কিনোয়া ফসলটি একটি স্বল্পমেয়াদী ফসল। এটি রবিশস্যের দানাদার জাতীয় ফসল। কিনোয়া ফসলের শস্য দানার রং তিন ধরনের হয়ে থাকে সাদা, লাল ও কালো। আবাদে খরচের চেয়ে লাভই বেশি। খরাপ্রবণ ও লবণাক্ত দুই ধরনের জমিতেই কিনোয়া চাষ করা যায়। এটি নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে চাষ করা হলে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ফলন ঘরে তোলা যায়। উৎপাদন ভালো হলে প্রতি বিঘায় ৬ থেকে ৭ মণ কিনোয়া উৎপাদন হয়। সুপার সপসহ অনলাইনে মানভেদে এ সুপার ফুডটি প্রতিকেজি ৬০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। এতে বিঘা প্রতি জমিতে লাখ টাকার উপরে আয় করা সম্ভব।
জানা যায় দেশে কিনোয়ার চাষের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ফসলটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে বাংলাদেশে কিনোয়া সম্পর্কে কৃষকরা অবগত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি কিনোয়ার মার্কেট। এটি রাজধানী বেশ কিছু সুপার শপগুলো সংগ্রহ করে থাকেন। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর সুপারশপে কিনোয়া পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে কিনোয়া আমদানি করে কিনোয়ার চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। আমদানিকৃত কিনোয়ার প্রতি কেজির দাম হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
ভাত বা রুটি খেতে খেতে মুখে যদি অরুচি ধরে তাহলে কিনোয়া হতে পারে উত্তম বিকল্প। এটি একটি সুষম খাদ্য। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি সিক্স, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ এবং ফাইবার রয়েছে। পুষ্টিহীনতা রোধে তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনা। প্রায় সকল প্রকার পুষ্টি গুণ আছে বলে কিনোয়া ‘সুপার ফুড’ হিসেবে পরিচিত।
ভাত, রুটির বিকল্প হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকা, চীন ও ভারতের মানুষ কিনোয়া খায়। ফসলটির পুষ্টি সমৃদ্ধতার কারণে ল্যাটিন আমেরিকাভুক্ত দেশে দানা, ফ্লেক্স, পাস্তা, রুটি, বিস্কুট, বেভারেজ হিসেবে কিনোয়া ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারতসহ ৯৫টিরও অধিক দেশে কিনোয়া চাষাবাদ হচ্ছে। এসব দেশের পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে।
কিনোয়ায় রয়েছে বহু উপকারিতা। তার মধ্যে এটি মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে স্বস্তি দেয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, রক্ত স্বল্পতা দূর করে, ত্বক ও চুলের সুস্থতায় কাজ করে, বলি রেখা দূর করে ও ওজন কমাতে ব্যাপক কাজ করে কিনোয়া। এসব ছাড়াও নানান পুষ্টিকর উপাদান থাকায় কিনোয়াকে সুপার ফুডই বলছেন পুষ্টিবিদরা।
পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচাললক (উদ্যান) সুবোধ চন্দ্র রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিয়াসিডের মতোই কিনোয়া সুপার ফুড খ্যাত ফসল। পঞ্চগড়ের সদর উপজেলায় আমিনুর রহমান নামের এক কৃষক ১২ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন। এটি কিভাবে আরও সম্প্রসারিত করা যায় তা নিয়ে কৃষি বিভাগ করছে। আগামীতে কিনোয়া আবাদ বৃদ্ধির লক্ষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করব। এ জন্য মাঠ পর্যায়ে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরার্মশ দেওয়ার কথাও জানান তিনি।