নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে নৌপরিবহন মালিক গ্রুপ যেখানেই নির্বাচন সেখানেই প্রার্থী হন খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম। গত ১৫ বছরে প্রায় অর্ধশত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি। প্রার্থিতার জানান দিতে সারাবছরই তাঁর ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে থাকে নগরীর প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়। অতি প্রচারে বিরক্ত হয়ে দলের নেতাকর্মীরাই তাঁর নাম দেন ‘প্যানা সাইফুল’। গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও এবার প্রার্থী হয়েছেন খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের পরিচালক পদে।
এর আগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন। একপর্যায়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। পলাতক থেকে তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহের বিষয়টি হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের নির্বাচনে গত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে ম্যানেজারকে দিয়ে পরিচালক পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন সাইফুল। সংগঠনের ২০টি পদে দুটি প্যানেলের কোনোটিতেই তাঁকে রাখা হয়নি।
গত ৪ আগস্ট দলীয় কার্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সংঘর্ষ হয়। সেই সংবাদ পেয়ে অস্ত্র হাতে সাইফুল কার্যালয়ের দিকে যান। সম্প্রতি ওই ছবি দিয়ে নগরীতে পোস্টারিং করা হয়েছে। এতে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
জাতীয় সংসদ ছাড়াও খুলনা সিটি করপোরেশন, আইনজীবী সমিতি, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, চেম্বার অব কমার্সসহ গত ১৫ বছরে বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সাইফুল। দলীয় প্রভাব ব্যবহার করে কোথাও কোথাও বিজয়ী হয়ে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এনিয়ে আইনজীবী সমিতির বর্তমান কমিটি দুটি মামলা করেছে।
সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয় সাইফুলের বাড়িতে। দরজা, জানালা-টাইলসও খুলে নিয়ে যায় নানা আসবাব। জেলার বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ৮টি মামলা হয়েছে। গত আড়াই মাস ধরে পালিয়ে আছেন তিনি।
সাইফুল জেলা আইনজীবী সমিতি ও জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশরে সভাপতি ও বাফুফের সদস্য পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। এছাড়া বিভিন্ন সময় খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি, খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি, বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব, খুলনা শিশু হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক, শেখ কামাল স্মৃতি সংসদের সভাপতি, সাউথ হেরাল্ড ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহসভাপতি এবং আযম খান সরকারি কমার্স কলেজের ভিপি ছিলেন। কিছু জায়গায় ভোটে, কিছু জায়গায় ভোট ছাড়াই জয়ী হন। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও প্রার্থী হয়েছিলেন।
সর্বশেষ দুটি কেসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও খুলনা-৫ আসনের প্রার্থী হতে ব্যাপক প্রচার চালান। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দেন। দল থেকে মনোনয়ন না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হননি।
গত ২৮ আগস্ট খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির ৭৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুল ইসলামসহ ৫ জনের নামে সদর থানায় মামলা হয়েছে। মামলার বাদী সমিতির সদস্য সচিব নুরুল হাসান রুবা জানান, এই অভিযোগ ছাড়াও ২০২৪ সালে ক্যাশ থেকে ৭০ লাখ টাকা গ্রহণ, তাঁর ব্যক্তিগত প্রচারণার বিলবোর্ড-ফেস্টুনের ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা বিল আইনজীবী সমিতির তহবিল থেকে পরিশোধসহ অনেক অনিয়মের অভিযোগ আছে।
আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে বিচারকদের চাপ প্রয়োগের ঘটনায় শুনানিতে ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর তাঁকে ভর্ৎসনা করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছিলেন, ‘শুধু আইনজীবী সমাজেরই না, আপনি খুলনার কলঙ্ক।’
একই ধরনের অভিযোগ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের নেতাদের। গত ১৫ বছর তিন দফায় ৬ বছর সংগঠনটির মহাসচিব পদে ছিলেন সাইফুল। ওই সময়ও ব্যক্তিগত প্যানা ফেস্টুন, অনুদানের টাকা গ্রুপের তহবিল থেকে প্রদান করতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘ইলেকশনের নেশা তারে (সাইফুল) ছাড়তেছে না। মালিক গ্রুপ থেকে অনেকটা অপমান করেই বের করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। এখন পালিয়ে রয়েছেন। কার বুদ্ধিতে ভোট করতে আসলেন কেউ বুঝতে পারছে না।’
এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজেই কোনো প্যানেলে যাইনি। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নৌপরিবহনে
আমি যে রেট তৈরি করে দিয়েছি, সেই রেট
এখনও চলছে। আমি যে উন্নয়ন করেছি, তারপর আর বড় উন্নয়ন হয়নি। এখন ভোটাররা যদি আমাকে চায় ভোট দেবে। ভোট না দিলে হেরে যাব।’ তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। সমিতির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ বানোয়াট। খুব শিগগিরই জামিনের আবেদন করবেন।