![পর্তুগালে অভিবাসন ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের চ্যালেঞ্জ](https://www.newspostbd.com/wp-content/uploads/2025/02/portugal1-20250211135243.jpg)
ক্রীড়া ডেস্ক :
পর্তুগালের অভিবাসন অধিদপ্তর এজেন্সি ফর মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাসাইলামের (আইএমএ) হিসাব অনুযায়ী গত এক দশকে পর্তুগালে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে মাত্র ১ হাজার ৭ জন বাংলাদেশি পর্তুগালে বসবাস করতেন, ২০২০ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯১৬ জনে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ হাজার ৬৬৬ জনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে পুরুষ ২০ হাজার ৩৯৫ জন এবং নারী ৫ হাজার ২৭১ জন।
২০২৩ সালে ১০ হাজার ৭৭ জন বাংলাদেশি পর্তুগালে বসবাসের অনুমতি বা রেসিডেন্ট কার্ড পেয়েছেন, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন তথ্য মতে জানা গেছে, আরও ২০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নিয়মিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পর্তুগিজ নাগরিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধির হার পর্তুগালে বাংলাদেশি কমিউনিটির ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নির্দেশ করে।
আবাসন সমস্যা
তবে এ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। বিশেষ করে আবাসন সংকট একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০১৫ সালের পর থেকে পর্তুগালে বাড়ি ভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে, যা স্বল্প আয়ের প্রবাসীদের জন্য বিশেষভাবে কষ্টকর। নতুন আসা অভিবাসীরা এ সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ছেন।
পর্তুগাল সরকার আবাসন সংকট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন বাড়ি ভাড়ায় আর্থিক সহযোগিতা। তবে নতুন আগত অভিবাসীরা এ সহযোগিতার আওতায় পড়ছেন না। এমনকি এ বিষয়টি কীভাবে কার্যকর হয় তা অভিবাসীদের অনেকে সুস্পষ্টভাবে জানেন না। এমনকি অথরিটিও বিষয়টি সঠিকভাবে জানাতে পারেনি।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পরিবারের জন্য একটি বাসা ভাড়া নিতে পারেননি আবুল হাশেম নামের এক প্রবাসী। তিনি জানিয়েছেন, পরিবার নিয়ে দুটি ফ্যামিলির সঙ্গে একটি বাসা শেয়ার করতে হচ্ছে। বলা যায় একটি অমানবিক পরিস্থিতি। তবে আয় ও ব্যয়ের সমন্বয় করে মেনে নিতে হচ্ছে এ কঠিন বাস্তবতা।
অভিবাসন আইনের পরিবর্তন
তবে বাড়ি ভাড়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটি সেটি হচ্ছে নতুন আগতদের নিয়মিত হওয়ার অপেক্ষা। অর্থাৎ পর্তুগালে বসবাস অনুমোদন বা রেসিডেন্ট কার্ড প্রাপ্তি। পর্তুগাল সরকার গত সেপ্টেম্বর মাসে অভিবাসন সংক্রান্ত অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য নতুন মিশন কাঠামো তৈরি করেছে। নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট অ্যাপয়েন্টমেন্টে হাজির হয়ে সব ডকুমেন্ট সাবমিট করেছেন প্রবাসীরা। তারপরও নির্ধারিত তিন মাস পরে রেসিডেন্ট কার্ড পাচ্ছেন না অভিবাসীরা।
অপরদিকে নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাবমিট না করার কারণে অভিবাসন অধিদপ্তর অনেক অভিবাসীকে নতুন করে কাগজপত্র দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি হচ্ছে সেনজেন ইনফরমেশন সিস্টেমে আবেদনকারীর অন্য দেশের উপস্থিতি। অর্থাৎ আবেদনকারী পর্তুগালে নিয়মিত হওয়ার জন্য আবেদন করার আগে বা পরে সেনজেনভুক্ত অন্য দেশে অভিবাসী বা শরণার্থী হিসেবে নিয়মিত হওয়ার আবেদন করেছিলেন, যা বাতিল করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার নোটিফিকেশন দেওয়া হয়েছে।
রেসিডেন্ট কার্ড নবায়নে জটিলতা
অপরদিকে নিয়মিত অভিবাসীরা তাদের বসবাস অনুমোদন বা রেসিডেন্ট কার্ড নবায়ন করতে পারছেন না। যদিও দেশটির অভিবাসন অধিদপ্তর আগামী ৩০ জুন ২০২৫ সাল পর্যন্ত সব ভিসা এবং রেসিডেন্ট বর্ধিত করেছে এবং খুব ধীরস্থিরভাবে কার্ড নবায়নের জন্য কিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে, যা অনেকটাই ধীর এবং অপ্রতুল। তবে দেশটিতে বসবাস করতে অসুবিধা না হলেও ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে অভিবাসন অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা শিগগিরই বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় আগতরা কর্মহীন
এদিকে গত ২০২৪ সালের ৩ জুনের পর থেকে সহজ শর্তে নিয়মিত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করার পর ওয়ার্ক পারমিট ভিসার মাধ্যমে বেশ কিছু বাংলাদেশি পর্তুগালে এসেছেন। তবে তারা যেসব কোম্পানিতে ওয়ার্ক পারমিটে এসেছেন সেসব কোম্পানি তাদের কাজ দিতে পারছে না অথবা তারা সেসব কোম্পানিতে কাজ করছেন না। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি পর্তুগালে প্রবেশ একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। যার ফলে পর্তুগালে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সুযোগকে একটি ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাংলাদেশি জানিয়েছেন, তিনি শুধু ইউরোপে প্রবেশের জন্য ওয়ার্ক পারমিট ভিসার ব্যবহার করছেন। কোনোভাবেই তিনি কৃষিকাজ অথবা নির্ধারিত কাজে অংশগ্রহণ করবেন না। এমনকি সুযোগ থাকলেও তিনি সেটি করবেন না বলে জানিয়েছেন। অথচ তাকে এ প্রক্রিয়াতে পর্তুগালে আসার জন্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। যদিও তিনি রাজধানীর লিসবনে চাকরি খুঁজছেন তবে পর্তুগিজ ভাষা না জানার কারণে সেটি হচ্ছে না। ফলে সামনের দিকে তার জীবন বিভীষিকাময় হতে পারে, সেটিও অনুধাবন করছেন।
অনিয়মিত অভিবাসীদের অনিশ্চয়তা
হঠাৎ করেই ২০২৪ সালের ৩ জুন পর্তুগালে সহজ শর্তে নিয়মিত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার কারণে বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি আশঙ্কার মধ্যে জীবনযাপন করছেন। কেননা তারা জুনের আগে দেশটিতে এলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরিতে তাদের অনেকটা সময়ক্ষেপণ হয়। ফলে তারা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। যদিও ইতোমধ্যে পর্তুগিজ সরকার একটি সুযোগ দিয়েছে। যারা ৪ জুনের মধ্যে দেশটির সোশ্যাল এবং ফিন্যান্স নম্বর বের করতে পেরেছেন, এমনকি কাজ করে যাচ্ছেন– এসব অভিবাসীকে নিয়মিত হওয়ার জন্য তাদের যোগাযোগের তথ্য সাবমিট করার একটি সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে পর্তুগিজ দূতাবাস না থাকায় ভোগান্তি
বাংলাদেশে পর্তুগাল দূতাবাস না থাকার কারণে প্রবাসীরা পারিবারিক পুনর্মিলনে পর্তুগালে আসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। পর্তুগালে স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষা এবং শ্রমবাজারের প্রবেশের ব্যাপক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভিসা জটিলতার কারণে বাংলাদেশিরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছেন না। এতে যেমন বাংলাদেশ সরকার রেমিট্যান্সের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অপরদিকে এখানে বসবাসকারী অভিবাসীদের পারিবারিক পুনর্মিলনের ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এমনকি ভারতের দূতাবাসে ভিসা সাবমিটের ক্ষেত্রে ভ্রমণে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ তাদের অর্জিত রেমিট্যান্স হারাচ্ছে।
বাংলাদেশে পর্তুগালের একটি দূতাবাস বা কনস্যুলার সেবা প্রদানে বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকারগুলো আশা প্রকাশ করলেও আলোর মুখ দেখতে পায়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারিক আহসান পর্তুগালে নিয়োজিত থাকাকালীন বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, বৈঠক এবং মন্ত্রী/সচিব পর্যায়ে দু’দেশের মধ্যে ভ্রমণ হলেও দূতাবাস বা ভিসা কনসুলার স্থাপনের বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি।
সোহেল নামের এক অভিবাসী জানান, আইনজীবীর মাধ্যমে অনেক অর্থ ব্যয় করে পরিবারের পুনর্মিলনের জন্য একটি অনুমতিপত্র পেয়েছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত ভিসা না দেওয়ায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে পাওয়া অনুমোদনটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে অনিশ্চিতভাবে পরিবার থেকে দূরে থাকার মানসিক অস্থিরতা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে আবেদন জানান যাতে দ্রুত সময়ে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে পর্তুগালের ভিসা সাবমিট করার জন্য একটি কনস্যুলার সেবা চালু করা হয়।
কট্টর ডানপন্থিদের উত্থান ও ইসলাম ফোবিয়া
গত কয়েক বছরে পর্তুগালে কট্টর ডানপন্থি দলের উত্থানের কারণে প্রতিনিয়ত অভিবাসীরা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত মারতিম মুনিজ অঞ্চলটি বারবার পর্তুগালের কেন্দ্রীয় সংবাদমাধ্যমে স্থান পাচ্ছে। কট্টর ডানপন্থিরা বাংলাদেশিদের টার্গেট করছেন। এর প্রধান কারণ বাংলাদেশিরা ইউরোপিয়ান কালচারে অনগ্রসর ও মুসলিম। কেননা, ইউরোপের কট্টরপন্থি মনোভাব স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম ফোবিয়ার দিকে ধাবিত হয়। বাংলাদেশিদের পুঁজি করি কট্টর রাজনীতিবিদরা অভিবাসন বিষয়ে দেশটির নীতির সমালোচনা করছেন। ফলে সরকারও একের পর এক এ বিষয়ে কঠিন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের ইমেজ রক্ষায় দেশটিতে বসবাসকারী প্রবাসীদের দেশটির নিয়মকানুন মেনে চলার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশি ও কমিউনিটির পরিচিত মুখ রাজিব আল মামুন। তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবেই আমাদেরকে এ দেশের নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। এ দেশের নিয়মকানুন মেনে চলা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই নিয়মকানুন আমাদের ইসলামের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়। অবশ্যই আপনাকে আপনি যেখানে বসবাস করেন সেই দেশের নিয়ম মেনে চলতে হবে।
এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সামাজিকের যোগাযোগ মাধ্যমে পর্তুগালে ভিসা বিজ্ঞাপনের কমতি নেই। লোভে পড়ে হাজারো অভিবাসী ফাঁদে পা দিচ্ছেন। যদিও এদের বেশির ভাগই পর্তুগালে আসতে পারছেন না। কেননা, বিভিন্ন ভুয়া এজেন্সির মাধ্যমে অর্থ হারাচ্ছেন তারা। এমনকি যারা পর্তুগালে আসতে পারছেন তারাও অর্থনৈতিক অসংগতির মধ্যে জীবনযাপন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে সার্বিক বিবেচনায় পর্তুগালকে বেছে নেওয়ার বিষয়টি আরও বেশি করে খতিয়ে দেখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন দেশটিতে বসবাসরত অভিবাসন