পাঁচ বছরে বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জে ভেসে গেছে ৬০০ কোটি টাকার ধান
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
হাওরে প্রতি বছর কৃষকদের সোনালী ধান রক্ষায় নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ। তবে সেই বাঁধের কাজ কোনো বছরই নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় থাকেন কৃষকরা। গত পাঁচ বছরে অকাল বন্যায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জের ৬শো কোটি ২০ লাখ টাকার ধান ভেসে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।হাওরপাড়ের কৃষকদের দাবি, হাওরের ফসল রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেন স্থায়ী সমাধান খোঁজে সরকার।
সুনামগঞ্জের করচার হাওর পাড়ের কৃষক শাহাব উদ্দিন। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে ৫ একর জমিতে রোপণ করেছেন বোরো ধান। কিন্তু তার চোখেমুখে আতঙ্ক। কারণ উজানের ঢলে বাঁধ ভেঙে ধান ভেসে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাবেন তিনি।শাহাব উদ্দিন জানান, হাওরের বাঁধের কাজ এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। যার ফলে ধান ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শুধু শাহাব উদ্দিন নয়, একই আতঙ্ক নিয়ে চলতি বছর সুনামগঞ্জের ৪ লাখ কৃষক দুই লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করেছেন। যেখান থেকে এবছর ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিনের আশা করা হচ্ছে। যার মূল্য চার হাজার ১১০ কোটি টাকা।তবে হাওরপাড়ের কৃষকরা বলছেন, অনেক কষ্ট করে বোরো ধান রোপণ করছি, কিন্তু বাঁধের কাজ সঠিক সময়ে শেষ না হলে ঢলের পানিতে আমাদের ধান নষ্ট হয়ে যাবে। বছরে বছরে এই বাঁধ নিয়ে কৃষকদের খুব আতঙ্কে থাকতে হয়।
কৃষি বিভাগ বলছে, গত পাঁচ বছরে অকাল বন্যায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জের ৬শো কোটি ২০ লাখ টাকার ধান ভেসে গেছে। তারমধ্যে ২০১৭ সালে সাড়ে ৪৪৬ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ৫১ লাখ টাকা, ২০১৯ সালে ৭১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০২২ সালে ৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও ২০২৩ সালে ১ কোটি ৬ লাখ টাকার ধান অকাল বন্যায় ভেসে যায়।
আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ধান রক্ষায় ষাট দশক থেকে নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ। এই বাঁধগুলো নদীর পানি হাওরে ঢুকতে বাধা প্রদান করে। ফলে রক্ষা পায় বোরো ফসল। প্রতি বছরই এসব বাঁধ সংস্কার ও পুনর্র্নিমাণ করা হয়। তবে কোনো কোনো বছর অকাল বন্যায় হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় কৃষকের সোনালী ফসল।এখন প্রশ্ন সরকারের শতকোটি টাকা ব্যয়ে এসব বাঁধ কৃষকদের কতটুকু কাজে লাগছে কিংবা হাওরের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে কী ভাবছেন কৃষকরা।
চলতি বছর সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৩৩টি অংশে ৫৯১ কিলোমিটার বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। তবে কাজ শুরু হওয়ার ১ মাস পেরিয়ে গেলেও বাঁধ নির্মাণের তেমন অগ্রগতি নেই। সেইসঙ্গে বছরে বছরে সরকারের শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা এসব বাঁধের কাজের গুণগত মান ও যুক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কৃষকরা।
তারা বলছেন, অল্প বৃষ্টি কিংবা উজানের ঢলের পানিতে এসব বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় সোনালী ফসল। তাই প্রতিবছর সরকার ফসল রক্ষায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধের কাজ না করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাওরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। এতে সরকারের যেমন বছরে শতকোটি টাকার ব্যয় কমবে তেমনি হাওরের কৃষকরাও নিশ্চিন্তে সোনালী ধান ঘরে তুলতে পারবেন।
কৃষকরা জানান, হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে হাওরের গুরুত্বপূর্ণ ক্লোজারগুলো স্থায়ীভাবে যেন নির্মাণ করা হয়। সেইসঙ্গে নদীগুলো খনন করলে পাহাড়ি ঢলের পানি নামলেও বাঁধের ওপর চাপ কম পড়বে।
এদিকে বেলা’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাঁধ যে লাগবে সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু কৃষকের ফসল রক্ষার নাম করে যে হাজার কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে সেটা কৃষকের কোনো কাজে লাগছে না। তাই সকলের সমন্বয়ে হাওরকে বাঁচিয়ে রেখে স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলছেন, বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদী খননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শমসের আলী জানান, হাওরের ১৬ কিলোমিটারে স্থায়ীভাবে বাঁধ নিমার্ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে প্রতি ১ কিলোমিটার বাঁধে যে ২৫ থেকে ২৬ লাখ টাকা ব্যয় হতো সেটি বেঁচে যাবে।সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল বলেন, বাঁধের কাজে কেউ অনিয়ম করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।