
বিনোদন ডেস্ক:
এ সভার ঘটনাবলি যেন একটি উল্টা পুরাণ, যা মানুষের জীবন থেকে ধার করা বয়ান নিয়ে পাখিদের আত্মিক অনুসন্ধানের যাত্রার বয়ান। আমরা যখন চীন-জাপানের রূপকথায় দেখতে পাই চাঁদ-সুরুজ, ড্রাগন-দেবদূত, প্রাণী-লতাপাতার জীবনের গল্প-সংলাপ দিয়ে মানুষের নৈতিকতা শিক্ষার গল্প। এ গল্পও ঠিক একই ধরনের কাল্পনিক অভিযাত্রার বর্ণনা।
গত ৭-১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় এ রকম একটি মরমি নাট্য প্রদর্শিত হলো। পারস্যের মরমি কবি ফরিদুদ্দিন আত্তারের ‘মানতিকুত তায়ের’ কাব্য অবলম্বনে এ-সময়ের জীবন, রাজনীতি ও আত্মঅভিঘাতের এক দুঃসাহসী প্রয়াস, যার নাট্যরূপ দিয়েছেন ড. শাহমান মৈশান। নির্দেশনা দিয়েছেন ড. আহমেদুল কবির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের প্রযোজনা এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা হলেও নাটকের মঞ্চ রূপায়ণ, অভিনয়ের ভাষা ও অনূদিত দক্ষতা প্রশংসার দাবিদার। নাটকের অভিনয়, আলোকসম্পাত, মঞ্চ, পোশাক, সাজ-সরঞ্জামের সুবিন্যস্ত ব্যবহার দেশজ পরিবেশনা শিল্পকে নতুন উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশের নাট্যনির্মাণ কৌশলের প্রথাগত ধারা কোথাও কোথাও ভেঙে দিয়ে দক্ষতা ও সৃজনী মেধার নতুন চিন্তাকে উস্কে দেয়, সে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুণপনা যে প্রথাসিদ্ধ প্রতিবেশকে অনাবৃত করে এবং বিশ্বনাট্যের আস্বাদনে বিমোহিত করে, তার নমুনা পাওয়া গেল।
নাটকের মূল উপপাদ্য মূলত আত্মিক অনুসন্ধানের উদযাপন, যা কঠিন ও তিতিক্ষাময়। বিশেষ করে জাগতিক জীবনের দাসত্ব-ধারণা ও আত্মার মুক্তি, ভয় ও নির্ভয়ের দ্বন্দ্ব, প্রেম ও প্রতারণার মন বিকিরণ, মৃত্যুর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, সংকীর্ণ মনের স্থবিরতা, সত্যের ভেতর দিয়ে নতুন মহাসত্যের উন্মোচন, পাখির ডানার শক্তি ও তাঁর সম্ভাবনা, মানবিকীকরণের ভেতর দিয়ে নিজকে আবিষ্কার এবং অপরাজেয় সাহসিকতার সরল পথের আভিযাত্রিক বোধ নতুনভাবে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন জাগায়।
আলোর সঙ্গে ডানা প্রসারণের যে সম্পর্ক, তার সঙ্গে নৈসর্গিক সুর অনুপম মুগ্ধতা দান করেছে। ড. সাইদুর রহমান লিপনের আবহ সংগীত এবং ধীমান চন্দ্র বর্মণের আলোক নির্দেশনা যেন এ পাখিদের ডানার হাওয়া কিংবা দমের নির্ভরতা দিয়ে কুশীলবদের। প্রতিটি পাখি প্রজাতির শরীরের সক্ষমতার সঙ্গে মানুষের জীবনধারায় যে কতটা সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, এবং মানুষের জীবনের নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ভেতর ভুলকে শোধরে নেওয়ার কত যে জ্ঞান ও অনুধাবনের ইশারা রয়েছে, তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে।
সুফি মতবাদের উসুলে সাবা বা সপ্তকর্মের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষের মুক্তি সম্ভব, আবার এ মুক্তির সঙ্গে মানুষের স্বপ্ন কিংবা লক্ষ্যের মিল না-ও থাকতে পারে। তবুও জীবনকে দহন করেই খাঁটিত্ব অর্জন করতে হয়, সেই উত্থান কিংবা উৎসে ফেরার ইতিহাস নাট্য-বিনির্মাণের পরতে পরতে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ ভাবনাকে নির্দেশকের ভাষায় বলা হয়েছে ‘নাটকটি শুধু একটি মঞ্চ-প্রযোজনা নয়, এটি আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রার এক প্রতীকী উপস্থাপন’। নাট্যকার অন্যভাবে বলেছেন ‘এই নাটক হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের সম্মিলিত রুহের শিহরণ-কম্পিত আধ্যাত্মিকতার এক রাজনৈতিক নাটলিপি’।
দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পৃষ্ঠপোষকতা মঞ্চের আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে উতরে দিতে বেশ সহায়ক হয়েছে। বাংলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঘোর লাগা মানুষের দিশাহীন অভিগমনে নুয়ে পড়েছে সমাজ ও জীবনের নৈতিক প্রতিবেশ, মনের ভেতর অহর্নিশি সংশয় ও অস্থিরতা, সেখানে এ প্রযোজনা একটু প্রশান্তি দিয়েছে, থিতু হবার উপায় রেখেছে। মরমিবাদ সে কারণেই হাজার বছর ধরে লোকসমাজের কাছে প্রশ্রয়ের চাঁদোয়া হিসেবে টিকে আছে। গ্রামবাংলার দরগা-আখড়া মাজারে আত্মান্বেষণের সাধনা নানা ভঙ্গিতে টিকে আছে, সেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উদযাপিত হয়, কিন্তু এ মহাশহরের মানুষেরা কেন ভেতরের বৈষয়িকতা ও আত্মানুশীলনের চর্চা থেকে দূরে থাকে? এ নাট্য প্রচেষ্টা সে প্রশ্নেরও মুখোমুখি দাঁড় করায় বারবার।