পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন: বেগম রোকেয়াসহ প্রথিতযশা লেখকদের গদ্য-পদ্য বাদ
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
নতুন পাঠ্যবই পেতে শুরু করেছে সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। অন্তর্র্বতী সরকারের প্রথম প্রকাশিত এসব বইয়ে বিষয়বস্তুর পাশাপাশি বড় পরিবর্তন এসেছে আধেয়তে (কনটেন্ট)। শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া পাঠ্যবই বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন নতুন গল্প-কবিতা যুক্ত করায় বাদ পড়েছে অনেক কিছু।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার লেখাও বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেলিনা হোসেনের পাঁচটি, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের দুটি, সৈয়দ শামসুল হকের একটি, রোকনুজ্জামান খানের একটি, নির্মলেন্দু গুণের একটি ও সাবেক আমলা কামাল চৌধুরীর একটি লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে ইতিহাস বর্ণনায়। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জীবনী ও কর্মকাণ্ড নিয়ে আধেয় থেকে ঝেড়ে ফেলা হয়েছে অতিরঞ্জিত ইতিহাস। রাজনীতিকদের সম্মান দেওয়া হয়েছে ব্যক্তি-বন্দনা কমিয়ে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ সালের পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পরিমার্জিত বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। এ ক্ষেত্রে এনসিটিবির ৪১ বিশেষজ্ঞ ৪৪১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করেছেন।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এ বছর সাতটি গদ্য-পদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে যুক্ত করা হয়েছে নতুন আটটি গদ্য-পদ্য। দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত হয়েছে সিংহ আর ইঁদুরের গল্প। শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা ‘সোনার ছেলে’ বাদ দিয়ে যোগ করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর ‘দুখু মিয়ার জীবন’। ‘পহেলা বৈশাখ’ গদ্য করা হয়েছে ‘নববর্ষ’। বইয়ের ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় পদ্মা সেতুর ছবি পরিবর্তন করা হয়েছে। নববর্ষ অধ্যায়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি বাদ দিয়ে নববর্ষের অন্য ছবি যুক্ত করেছে। তবে ইংরেজি ও গণিত বইয়ে তেমন পরিবর্তন পাওয়া যায়নি। তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে সংযোজন হয়েছে ‘ঘাসফড়িং ও পিঁপড়ার গল্প’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা’।
এ বছরের নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে সাতটি গদ্য ও চারটি কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে। যুক্ত হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর লেখা একটি সংকলিতসহ দুটি গদ্য। বদল হয়েছে একটি উপন্যাস। একই শ্রেণির ইংরেজি বই থেকে একটি অধ্যায় বাদ গেছে এবং জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি নিয়ে লেখাসহ নতুন তিনটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে।
নবম-দশম শ্রেণির বাদ দেওয়া সাতটি গদ্য হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’, কবীর চৌধুরীর ‘পয়লা বৈশাখ’, জহির রায়হানের ‘বাঁধ’, সেলিনা হোসেনের ‘রক্তে ভেজা একুশ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘নিয়তি’ ও ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘তথ্যপ্রযুক্তি’। অবশ্য একই বইয়ে জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ এবং জুলাই বিপ্লবের ওপর লেখা ‘আমাদের নতুন গৌরবগাথা’ নামে একটি সংকলিত গদ্য যুক্ত করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সুভা’ ও ‘লাইব্রেরি’ গদ্য দুটি আগের মতোই রাখা হয়েছে। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’ গদ্য বাদ গেলেও রাখা হয়েছে ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’। ‘নিয়তি’ বাদ দিলেও রাখা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘১৯৭১’। চারটি কবিতা বাদ দিলেও যুক্ত হয়নি একটিও।
বাদ দেওয়া চার কবিতা হলো– কাজী নজরুল ইসলামের ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’, নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ এবং কামাল চৌধুরীর ‘সাহসী জননী বাংলা’। কাজী নজরুল ইসলামের অন্য দুটি কবিতা ‘মানুষ’ ও ‘উমর ফারুক’ ঠিকই রয়েছে।
নবম-দশম শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বই থেকে ইউনিট ওয়ান হিসেবে থাকা ‘ফাদার অব দ্য নেশন’ অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। ‘সেন্স অব সেলফ’, ‘লোনলিনেস’ এবং ‘গ্রাফিতি’ নামে নতুন তিনটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘অনেকের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে মনে হতে পারে। কিন্তু একই বিষয়ে বিকল্প বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন, সেলিনা হোসেন ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লেখা সরানো হলেও একই বিষয়ে অন্যদের লেখা যুক্ত করা হয়েছে।’