সিলেট প্রতিনিধি:
পানি নামলেও বন্যার ক্ষত চিহ্ন রয়ে গেছে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের খাসিয়ামারা নদীর তীরের নোয়াপাড়া গ্রামে। আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে খাসিয়ামারা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় পুরো গ্রাম। চোখের পলকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গোলার ধান, চাল, পুকুরের মাছ, মুরগির খামারসহ সংসারের মূল্যবান জিনিস। তাছাড়া ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকের বাড়ি ফেরার অবস্থাও নেই। সবাই এখন তাকিয়ে সরকারের সহায়তার দিকে।
১৫ জুন রাতে মেঘালয় পাহাড় থেকে খাসিয়ামারা নদী দিয়ে প্রবল বেগে নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। ঢলে ভেঙে পড়ে খাসিয়ামারা নদীর বেড়িবাঁধের ৫০ মিটার জায়গা। ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের নোয়াপাড়া, ঝিরারগাঁও, মোহাব্বতপুর গ্রামের বেশির ভাগ ঘর বাড়ি। পরে ১৭ জুন চতুর্থবারের পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়ে প্লাবিত হয় পুরো ছাতক ও দোয়ারাবাজার ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা।
নোয়াপাড়া গ্রামের মিনারা খাতুন বলেন, পানি কমলেও বাড়িতে যাওয়ার উপায় নেই। সারা ঘরজুড়ে কাদা আর কাদা। না শুকালে বাড়ি ফিরে যাওয়া যাবে না।
এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতশত মানুষের একমাত্র বসত ঘর। সে ঘর সংস্কারের সামর্থ্য না থাকায় অনেকে বাড়ি যেতে পারছেন না। এসব কথা পুরো জেলার পুরো নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের।
জানা গেছে, ১৭ জুন থেকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিলেন। গত চার দিন ধরে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পাঁচটি পয়েন্টের মধ্যে ছাতক ছাড়া বাকি সব পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই হাওরের পানি বিভিন্ন নদনদী দিয়ে নিষ্কাশিত হচ্ছে। ফলে আতঙ্কিত মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।
সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিন ঘণ্টা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হলেও নদনদীর পানি বাড়েনি। উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মাওসিনরাম মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দ্রুত নেমে গেছে উঁচু এলাকার পানি। এখন নামছে নিচু এলাকার পানি। দুই দিন আগে সুনামগঞ্জ শহর থেকে বিদায় নিয়েছে বানের পানি। তবে অতি নিচু এলাকায় বন্যার স্তরের নিচের স্তরে যারা বাড়িঘর তৈরি করেছেন- তাদের ঘরের পানি নামছে দেরিতে। অতিনিচু এলাকার পানি নামতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে জানান স্থানীয়রা।
এদিকে সুনামগঞ্জের গভীর হাওর এলাকা বছরের ৬ থেকে ৮ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ২৭ মে তারিখ থেকে ১৬ জুনের মধ্যে চারবার জেলার ৭টি সীমান্ত নদী ও ৫০টি পাহাড়ি ছড়া দিয়ে উজানের ঢল নামে ভাটির দেশ সুনামগঞ্জে। ১৬ থেকে ২০ জুনের মধ্যে জেলার ১২ উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলার মানুষের ঘরবাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়। এসব উপজেলার সাড়ে ছয় লাখ মানুষ অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েন। জেলার ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্র ৭৮টি ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নেন।
উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিনটি ছাতক দোয়ারাবাজার ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা। বন্যায় স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরের পাঁচটি সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেসে যায়। ভেঙে যায় সংযোগ সড়ক। সড়ক জনপথের ১০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন হাজার ৬০০ পুকুরের মাছ ও মাছের পোনা ভেসে যায়। ৫০ লাখ টাকার গবাদি পশুর খাবার বিনষ্ট হয়। এক হাজার ৬০০ হেক্টর আউশ ধানের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ৫৬০ হেক্টর সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, বানভাসিদের মধ্যে এক হাজার টন চাল, সাড়ে তিন লাখ পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট, নগদ টাকা, শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলমান আছে। তালিকা প্রস্তুত হলে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সবাইকে সহযোগিতা করবে সরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, উজানের ঢল না নামলে বন্যা পরিস্থিতি খারাপের কোনও হওয়ার কথা নয়। স্থানীয়ভাবে হালকা বা মাঝারি বৃষ্টি হলেও পানি বাড়বে না। তবে উজানে ভারী বর্ষণ হলে পানি কিছুটা বাড়তে পারে। জুনে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কোন শঙ্কা নেই।